সকাল ১১টায় ঢাকাস্থ ঝালকাঠি জেলা সাংবাদিক সমিতির উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে “ধানসিঁড়ি নদী বাঁচাও ” শিরোনামে মানববন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।উদ্যোগটি দেখে খুব ভাল লাগল।ভাল লাগারই কথা। উদ্যোক্তাগণ অনেক আন্তরিকতার সাথে বেশ ফলাও করে এটা করতে পারায় আমাদের মত সাধারণ মানুষের মন পুলকিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু যাঁদের কে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে এই সুন্দর আয়োজন সেই পানিসম্পদ বিষয়ক যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি কতটা গুরুত্ববহ হয়েছে এটাই ভাববার।ঢাকাস্থ ঝালকাঠি জেলা সাংবাদিক সমিতির সম্মানিত সভাপতি জনাব মো: রেজাউল করিম সহ অন্যান্য উদ্যোক্তাবৃন্দ যে উদ্যোগটি নিয়েছেন সেই আলোকে স্থানীয় পর্যায়েও এ আন্দোলন চালিয়ে গেলে ঝালকাঠি জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিষয়টি বিবেচনায় নিবে এ বিশ্বাস রাখা যায়।কারণ বিশেষ সূত্র মমোতাবেক জানা যায় কয়েক বছর পূর্বে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল ঝালকাঠি জেলা পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং এ বিষয়ে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকৌশলী জাকির হোসেনের তত্ত্বাবধানে ঠিকাদার শামীম আহসান এর মাধ্যমে কাজটি শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখিনি। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ যিনি রূপসী বাংলার কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত যাঁর অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ কবিতার উদ্ধৃতির অবতারণা করেই আজকের এ লেখার মূল স্রোতধারায় প্রবেশ করতে চাই- “আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়” ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধানসিঁড়ি নদী আজ তার ঐতিহ্যের স্মৃতি ধরে রাখতে একেবারেই অক্ষম।ধানসিঁড়ি আজ বিলীনের পথে।কবি জীবনানন্দের কবিতায় স্থান করে নেয়া অনন্ত যৌবনা ধানসিঁড়ি নদী তার গৌরবদীপ্ত মহিমা নিয়ে যেভাবে তার কলকল ধ্বনিতে দু পারের জনজীবনকে মুখরিত করেছে, প্রীতিমুগ্ধ করেছে,যার জোয়ার ভাটায় বাংলার অবারিত প্রান্তরে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ হয়েছে,জাহাজ-স্টীমার-লঞ্চের শব্দে জনজীবন আকাশ বাতাস শ্রবণ মুখর হয়ে উঠেছে, বরিশাল বিভাগের অন্যতম বানিজ্যিক কেন্দ্র ঝালকাঠি বন্দর থেকে দক্ষিন বাংলার যেকোন স্থানে জলপথে যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে যে ধানসিঁড়ি নদী তার বর্তমান দুরাবস্থা প্রতিটি মানব হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করবেই।স্রোতস্বিনী ধানসিঁড়ির অপরূপ রূপ মহিমায় মুগ্ধ হয়ে কবি জীবনানন্দ তার কবিতায় তুলে আনেন ধানসিঁড়ির গৌরব গাথা রূপের মহিমা। বাংলাদেশ তথা বিশ্বদরবারে ধানসিঁড়ি নামটি ও তাই স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল। প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার আবু জাফরের কথা ও সুরে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে একটি দেশের গানেও উঠে এসেছে ধানসিঁড়ির কথা: “এই মধুমতি ধানসিঁড়ি নদীর তীরে নিজেকে হারিয়ে যেন পাই ফিরে ফিরে” সত্যিই ধানসিঁড়ি তার রূপ মহিমায় বাংলার গীতিকার, কবি,সাহিত্যিককে যে আকৃষ্ট করেছে এ কথা অনস্বীকার্য। প্রসঙ্গত নিজের একটি কথা না বললেই নয়। জীবনের বেশ কিছুটা সময় (২০০৩-২০১১) আমার অতিবাহিত হয়েছে চিলাই-তুরাগ-শীতলক্ষা বিধৌত, শাল-গজারের শ্যামলীমা শোভিত ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুর জেলায়।সেখানে অবস্থান কালে ঝালকাঠির রাজাপুরের একটা কলেজে অধ্যাপনার প্রস্তাব পেয়ে যাই। জানতে পারি কলেজটি জীবনানন্দের কবিতায় স্থান পাওয়া সেই ধানসিঁড়ি নদীর সন্নিকটে। কবি জীবনানন্দ,ধানসিঁড়ি নদী, কলেজে অধ্যাপনা বিষয়গুলোর সহজাত কল্পনা আমাকে সবমিলিয়ে অনেকটাই প্রলুব্ধ করল।কালবিলম্ব না করে যোগদান করলাম রাজাপুরের বর্তমানে কর্মরত আমার সেই কলেজটিতে।ধানসিঁড়ি দেখার অসংবরনীয় লোভে যোগদানের সপ্তাহ অন্তে কয়েকজন ছাত্র নিয়ে ধানসিঁড়ির পারে ঘুরতে গেলাম।ছাত্রবৃন্দ আমাকে ছোট্ট খাল সদৃশ ধানসিঁড়ি নদীটি দেখিয়ে বলল স্যার এটাই আপনার স্বপ্নের নদী।আমার অতি উৎসাহ মূহুর্তেই হারিয়ে গেল।হায় হায় একি দেখছি আমি। এই কী সেই ধানসিঁড়ি যার রূপ মহিমা সারাবিশ্বে বিরাজিত।আমার স্বপ্নের ধানসিঁড়ি দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এটা যে একটি নদী তা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হল।একটা মরা খালের মত পড়ে আছে। জোয়ার ভাটার ও কোন প্রকাশ নেই। কচুরিপানা ও ঝোপঝাড়ে নদীর শ্রী একেবারেই হারাতে বসেছে। নদীর পরিচর্যাহীনতায় ধানসিঁড়ির যৌবন আজ লুপ্ত প্রায়। এখন বলা যায় মৃত্যু পথযাত্রী ধানসিঁড়ি শুধুমাত্র অতীতের সাক্ষ্যবহন করে চলেছে।খননের অভাবে ভরাট হয়ে গেছে নদীর বর্তমান অংশের সিংহভাগ। কেউ কেউ ইতোমধ্যে কোন কোন স্থান দখল করে চাষাবাদ চালিয়ে যাচ্ছে কেউবা গড়ে তুলছে বসত বাড়ী। পলিজমে শুকিয়ে গেছে নদীগর্ভের বিস্তীর্ণ এলাকা।শুকনো মওসুমে কোনো কোনো স্থানে বলা যায় জুতা পায়ে পার হওয়া যায়। একটু মজা করেই বলতে হয় যে ধানসিঁড়ি নদী পার হতে ইজ্জত হারানোর ভয় একেবারেই কম। মহিলারাও অবলীলাক্রমে নদীটি পার হয়ে যাবে এ ব্যাপারে ইজ্জতহানীর কোন অবকাশ নেই এমনকি এতে ফরজও নষ্ট হয়না কারণ নদী পার হতে মানুষকে হাটুর উপরে কাপড় তুলতে হয়না। যাই হোক ধানসিঁড়ি যে তার সত্ত্বাকে হারাতে বসেছে এটা আজ সর্বজনবিদিত।স্থানীয় মনীষীদের মুখে শোনা যায় অতীতের এই প্রমত্তা ধানসিঁড়ির পারে বসেই জীবনানন্দ তাঁর কাব্যচর্চা চালিয়ে গেছেন আর ধানসিঁড়িকে তুলে ধরেছেন তার কাব্যকলার মাধ্যমে। ফলে ধানসিঁড়িও দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে আপন মহিমায় অনায়াসে।ঝালকাঠি জেলার মধ্যে ধানসিঁড়ির অবস্থান হওয়ায় এটা ঝালকাঠি জেলাকে করেছে ধন্য। ঝালকাঠি জেলা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম সুগন্ধা, এর উত্তর-দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত বিষখালী নদীটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মোড় নিয়ে কাঁঠালিয়ার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে বরগুনার দিকে বয়ে গেছে। উত্তর-পশ্চিম দিকে পিরোজপুরের কাউখালী বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে গাবখান নদীটি যার উপর এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম সড়কসেতু গাবখান সেতু নামে পরিচয় বহন করছে।সুগন্ধা, বিষখালী আর গাবখানের মুখূমুখি সংযোগস্থল থেকেই ধানসিঁড়ি নদীর গতিপথ শুরু। ঝালকাঠি জেলার গাবখান ইউনিয়নের বৈদারাপুর গ্রামের পাশ দিয়ে ধানসিঁড়ি নদীর অভিযাত্রা। বৈদারাপুর থেকে ধানসিঁড়ি ছত্রকান্দা গ্রাম হয়ে পিংড়ি,হাইলাকাঠি,মঠবাড়ী ও সুক্তাগড় ইউনিয়নের কোলঘেষে রাজাপুর সদর ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে জাংগালিয়া নদীতে গিয়ে মিশেছে। তিন দশক আগেও এই ধানসিঁড়িই ছিল রাজাপুর উপজেলার সাথে ঝালকাঠি জেলা সদরের একমাত্র সংযোগ সূত্র।ঝালকাঠি বা বরিশালে যেতে রাজাপুরের লোকজন এই নৌপথটিই ব্যবহার করতেন।বয়স্কদের মুখে শোনা যায় যৌবনে এ নদীতে বড় বড় জাহাজ লঞ্চ স্টীমার এমনকি দুই দশক আগেও এখানে ছোট ছোট লঞ্চ ও ট্রলার চলেছে।সেই নদীতে এখন নৌকা ও চলেনা এটা ভাবা যে কতটা দু:সহ তা কেবলমাত্র বিবেকবান মানুষই বুঝতে পারে। যোগাযোগ প্রযুক্তির অতি উন্নয়নের ফলে নদীপথে যাতায়াত বহুল্যাংশে হ্রাস পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ধানসিঁড়ির গুরুত্ত যে বেশ খানিকটা হ্রাস পেয়েছে তা অবলীলায় বলা যায়। ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি বিশেষ সূত্র মোতাবেক জানা যায় ২০১০-২০১১ অর্থবছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ধানসিঁড়ি নদীর উৎস মুখ হতে সাড়ে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে এই নদীটি খননের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। জানা যায় ঐ সময় সাড়ে চার কিলোমিটার খননের পর বরাদ্দজনিত ত্রুটির কারনে বাকী অংশ আর খনন সম্ভব হয়নি। রাজাপুর অংশের ধানসিঁড়ির দৈর্ঘ্য প্রায় ৮ কিলোমিটার যার অবস্থা সবচেয়ে বেহাল। ৮৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রাজাপুর অংশের পিংড়ি -বাঘরী- বাঁশতলার মোহনা পর্যন্ত খনন করা হয়েছিল বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ঝালকাঠি সূত্রে জানা যায়। খনন করা অংশ আবারও ভরাট হয়ে গেছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ঐ নির্দিষ্ট অংশ খননের মাধ্যমে জোয়ার ভাটার পানি ওঠা নামার ব্যবস্থাকরন সম্ভব হলে খননকৃত অংশ ভরাট হবার সম্ভাবনা থাকতনা। পরিশেষে এটাই বলতে হয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহনকারী ধানসিঁড়ি নদী বাঁচানোর এখনই সময়। এ নদী বাঁচানো এখন সময়ের যথার্থ দাবী। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিবর্গের সদিচ্ছা থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অগ্রসর হয়ে ধানসিঁড়ি নদীতে পুনরায় পানির স্রোত বইয়ে দেওয়া সম্ভব। ধানসিঁড়ি বাঁচাও আন্দোলন আরও জোরদার করার মাধ্যমে সম্ভব ধানসিঁড়ির পুন খননের পথ সৃষ্টি করা। ধানসিঁড়ি বাঁচাও আন্দোলন সকলের অংশগ্রহণে হয়ে উঠুক গন আন্দোলন। কতৃপক্ষ অগ্রসর হউক ধানসিঁড়ি বাঁচানোর কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি তার আপন মহিমায় একটু হলেও ফিরে আসার প্রয়াস রাখুক। ধানসিঁড়ি প্রেমী আমরাও রইলাম ধানসিঁড়ি বাঁচানোর সেই মহিমান্বিত দিনটির অপেক্ষায়। ফিরে আসুক আমাদের কবি হৃদয়ের চৈতন্যময় সেই হারানো দিনগুলো। আগত সে দিনগুলোকে বরন করে কবি জীবনানন্দের কালজয়ী উদ্ধৃতির অবতারণার মাধ্যমে ধানসিঁড়িকে নতুন করে আবিস্কার করে আমরা আবারও উচ্চারণ করব কবির সেই চির শাশ্বত চরন দুটি : আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয় হয়তোবা শঙ্খচিল শালিখের বেশে আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালবেসে।
প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস প্রান্ত
সাধারণ সম্পাদক
নদী পরিব্রাজক দল ঝালকাঠি জেলা .