প্রেমের বিয়ে ভাঙে কেন?

Slider লাইফস্টাইল

dfaf23cfb2aa9e35f17cf10d83ec7fa6-Untitled-1

বিয়ে তো অহরহ হচ্ছে। বিচ্ছেদও। প্রেমের বিয়ে নিয়ে সমাজে বেশ রসিকতা, কানাঘুষা চলে। প্রেমে পড়াটা সম্পূর্ণ একটা বায়োলজিক্যাল ব্যাপার। বিয়ে প্রেম করেই হোক আর পারিবারিক সম্বন্ধের মাধ্যমেই হোক—পান থেকে চুন খসলেই হলো, তা মেনে নিতে পরিবারে বেশ সমস্যা দেখা দেয়। বিয়ে মানেই জীবনের নতুন রোমাঞ্চ শিহরণ ভরা রোমান্টিক ইনিংসের শুরু। তাতে নানা রকম বৈচিত্র্য থাকবেই।
প্রেমের বিয়ে হলে তো কথাই নেই। দুজনের বনিবনা না থাকলে তাঁদের চেহারার মধ্যে বিষণ্নতা–কষ্ট–অভিমান ফুটে ওঠে বেশি। তার সঙ্গে একরাশ হতাশা। প্রেম করলাম, ভালোবাসলাম, সবার মতের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম; তারপরও এত কষ্ট কেমন করে সওয়া যায়।
সমস্যা নিয়েই এসেছিলেন এক জুটি। যখন জানতে পারি তাঁদের প্রেমের বিয়ে; অবাক হইনি। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেলেও নিজের বা শ্বশুরবাড়ির দিকের কেউই ভালোভাবে নিতে পারেননি তাঁদের। নিজেদের বোঝাপড়ায়ও এখন কোথায় যেন চিড় ধরেছে। দুজনেই যেন নীরবে একে অপরকে বলছে, এক ছাদের নিচে থাকার চেয়ে আলাদা থাকা ভালো। কিন্তু বাচ্চাদের জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। স্ত্রীর কতই বা বয়স। এখনই চোখের নিচে ক্লান্তি আর হতাশার কালি। স্বামীও অকালে বুড়িয়ে গেছে। সামাজিক বৈরিতা ও মুখ দেখাদেখি বন্ধের নিঃশব্দ সংক্রমণ মোকাবিলা বড় কঠিন।

প্রেমের বিয়েতে মোহ কাজ করে। ভালোমন্দ, লাভক্ষতি—কোনো কিছুই চোখের সামনে দেখা দেয় না। অন্ধত্ব পেয়ে বসে। ছেলেমেয়ে দুজনেই তাদের দায়দায়িত্ব ভুলে গিয়ে ভালো লাগা নিয়েই সবকিছুতে বিভোর থাকে। পরিবার–পরিজন তখন গৌণ হয়ে যায়। বাবা-মা তখন না পেরে মুখ বন্ধ করে থাকেন। তাঁরা হাজারো ভালো পরামর্শ দিলেও সেসব ভালো লাগে না প্রেম–জুটির। শত্রুতা বাড়িয়ে লাভ কি? নিঃশব্দে সব তরফেই দূরত্ব বাড়তে থাকে।
এক দম্পতি এলেন। স্বামী–স্ত্রী দুজনেই উচ্চশিক্ষিত। পড়তে পড়তে প্রেম। তারপর পরিবারের অমতে বিয়ে। একসময় মেয়েটির খালি হাতে এক কাপড়ে শ্বশুরবাড়িতে এসে ওঠা। স্বামীর পরিবার কিছুটা অসচ্ছল। মেয়ের ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত পরিবার। মেয়ের বাবা, ভাইবোন সবাই প্রতিষ্ঠিত। মেয়েটি যখন শ্বশুরবাড়িতে গেল, কথায় কথায় শাশুড়ির মুখ ঝামটা। বউকে অকারেণ বকাঝকা করেন। নিজের ছেলেকে শিক্ষিত করেছেন বেশ কষ্ট করে। ছেলেকে এভাবে বউয়ের পেছন পেছন ঘুরতে দেখতে হবে, তিনি মেনে নিতে পারছেন না। বউ যা পারছে তা করছে কিন্তু বাড়ির মানুষদের মন ভরাতে পারছেন না। কাজের মেয়ের মতো খাটাতে না পারার কষ্ট কুরে কুরে খাচ্ছে। এর মধ্যে মেয়েটি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘ছেলের বউ হিসেবে কাজের বেটি খুঁজছেন, তাহলে মেইড সার্ভেন্টকে বিবাহ করান। শিক্ষিত মেয়েকে ঘরে তুলে সংসারকে নরক বানাবেন না।’ গরম কড়াইয়ে যেন জলের ছিটা পড়েছে।
অনেক নাটক শেষে আলাদা সংসার। আর তখনই দেখা দিল স্বামীর পৌরুষময় চেহারা। তার মায়ের মতো সার্ভিস যেহেতু বউটি দিতে পারছে না, তাকে আর ভালো লাগছে না।
এখানে সময় ও জেনারেশন গ্যাপের বিষয়টি মোটেই আমলে নিতে রাজি নন কেউই। অল্পতেই খিটমিটি চলতে থাকে। এখন ভয়াবহ পর্যায়ে। শোনা যাচ্ছে স্বামীর অফিসে কর্মরত মহিলার সঙ্গে নটঘটও অনেক দূর গড়িয়েছে।
ফ্যামিলি কাউন্সেলিং যাঁরা করেন, তাঁরা দুটো পরিবারের সমঝোতাকে খুব গুরুত্ব দেন। অনেকের মতে, সমপর্যায়ে বিয়ে না হলে সমঝোতায় অনেক ব্যবধান থেকে যায়। কিন্তু, জীবন তো সোনার পাথরবাটি নয়।
বিয়ে একটি বাস্তবতা। একজীবনের মতো লম্বা একটা ইনিংস। আমৃত্যু থাকতে হবে নট আউট। সেটা প্রেমেরই হোক, কিংবা দুটো পরিবারের পাকাপাকি দেখায়ই হোক। সমস্যা বলে–কয়ে আসে না। আসে দৈব দুর্বিপাকের মতো। সমস্যাকে মোকাবিলার জন্য মানসিক শক্তি, ইচ্ছেই হচ্ছে বড় কথা।
সংসার সুখের হয় নানা রকম বোঝাপড়া, সমঝোতার গুণে। বিয়ের গাঁটছড়ার বন্ধন যখন হলো, এখন এটাকে সুখ–প্রশান্তির গৃহ হিসেবে টেকাতে হবে। খুনসুটি হবেই। দুপরিবার, আত্মীয়স্বজেনর টক্কর কমবেশি সবক্ষেত্রেই হয়। মনোবলকে রাখতে হবে দৃঢ়। ভালোবেসে বিয়ের বড় চ্যালেঞ্জই হলো, সেই সংসারকে সুখের সংসারে রূপান্তর। পারিবারিক বিয়ের চ্যালেঞ্জও একই। যার ঘর ভেঙে যাচ্ছে; সে সব কুল হারাতে চলেছে। ভালোবাসায় ভরে রাখতে হবে বিবাহিত জীবনের সব অধ্যায়। একদা একে অপেরর অচেনাকে করতে হবে চিরচেনার প্রেমের বন্ধন।
আরেকটি মেয়ে এল খালা আর মায়ের সঙ্গে। মেয়েটি বেশ সুন্দর ছিমছাম। মেয়েটিকে আনা হয়েছে যেন সে স্বামী, শাশুড়ির সঙ্গে একটু মানিয়ে চলে, তা যেন একটু বুঝিয়ে দিই। পছন্দের বিয়ে। পরিবার দুটিও সমান পর্যায়ের। কথা বলে দেখা গেল, মেয়েটিই খুঁতখুঁতে স্বভাবের। এ কারণে তার কারও বিশেষ করে শাশুড়ির চলনবলন একদম পছন্দ না। ময়লা নোংরা হাত দিয়ে ওর গ্লাস প্লেটে হাত দেয়। ওর স্বামী অফিস থেকে এসে হাত–পা না ধুয়ে বিছানায় উঠে বসে। এসব তার সহ্য হয় না। তাই আর থাকতে পারছে না। মেয়ের মা–খালা সবাই বুঝতে পারছে সমস্যা মেয়ের। সে যে শুচিবাই রোগে ভুগছে এটা মানতে নারাজ।
এই যে রোগের কথা বললাম, এটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। আমলে নিয়ে রাখুন সবাই। আমরা অনেকেই খুঁটিনাটি না জানা কিছু মনোসমস্যায় ভুগি; সেসবের কারণে যে সংসার গোল্লায় যাচ্ছে, মানতেই চাই না।

কেন হয় জটিলতা
পারিবারিক সম্বন্ধের বিয়েতে মুরব্বিদের খোঁজখবর নেওয়ার যে একটা সুফল পাওয়া যায়। প্রেমের বিয়েতে সে সুযোগ থাকে না। অ্যারেঞ্জড বিয়েতে পাড়া–প্রতিবেশী, অফিস সহকর্মী—কোনো কিছু বাদ যায় না। কিছু সমস্যা তাঁরা পারিবারিকভাবে আলোচনা করে মিটিয়ে ফেলেন বা ফেলার চেষ্টা করেন। অথচ প্রেমের বিয়েতে কিছু অপূর্ণতা থাকে। ছেলেমেয়ে দুজনেরই পারিবারিক সমস্যাগুলোকে জানা হয় না। নিজেদের বোঝাপড়াই যেন শেষ কথা। সামাজিকতার ধার ধারে না।
তাই যেকোনো সময় যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা পিছপা হন না। দায়িত্ববোধ তাঁদের মধ্যে ততটা গড়ে ওঠে না। পরিবারও এই সুযোগটা কাজে লাগায়। তাঁরাও সমস্যার সমাধানে না গিয়ে কীভাবে তিলকে তাল করতে হয়, সে রকম জটিলতায় হয় উৎসাহী। নাক গলানোর সুযোগ তো পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত।
পারিবারিকভাবে রুচি–সংস্কৃতির সম্মিলন যদি না ঘটে, তবে যেকোনো ধরনের বিয়েতেই মানিয়ে নেওয়াটা সবার জন্যই কষ্টকর। তবে মেয়েদের জন্য বেশি।
সংসারের দায়িত্বভার বণ্টন নিয়ে কোনো ছেলে বাবা–মায়ের সামনে কথা বলেছে এমনটা শুনি একবারেই কম। ছেলেরা যেন বিয়ে করেই খালাস। সব তাঁর বউকে মানিয়ে নিতে হবে। এই আদেশ অবজ্ঞা করলে কারও রেহাই নেই।
বিয়ের আগের চেহারা আর পরের চেহারা দেখে বউ হতাশ হন। ছেলের পরিবার ছেলেকে নিজের মতো করে নিতে চান। আর ছেলেও কিছুদিন পর আগের নানা দেওয়া কথা ও দায়দায়িত্বের ‘কমিটমেন্ট’ ভুলে যেতে থাকেন।
মেয়ের পড়াশোনা ক্যারিয়ার নিয়ে বিয়ের আগে সাহায্য–সহযোগিতার কথা দেওয়া হয়। কিন্তু বিয়ের পরই সেই একই ছেলে ইগো, অক্ষমতা, সামাজিকতার বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। নিজের মর্যাদা সম্মানটুকু হারিয়ে ফেলেন।

যা করা যেতে পারে
* পরিবার পরামর্শকেরা বলেন, প্রেম স্বর্গীয়। কিন্তু প্রেমে বেহুঁশ, বেদিশা হওয়া ঠিক নয়। প্রেম নিছকই ফাল্গুনের হাওয়া।
* বিয়ে হলো সামাজিক পারিবারিক স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। প্রেমের অনুভূতি যখন সঞ্চারিত হচ্ছে; তখন সেটা বিয়েতে গড়ানোর আগেই বাস্তব বুদ্ধি চোখ কান খোলা রাখা দরকার।
* অনেক প্রেমের বিয়ের টানাপোড়েন শেষে জানা যায়, কোনো এক পক্ষের প্রতারণাও কম দায়ী নয়। যেমনটা জেনে প্রেমের সূচনা; পরের বাস্তবতা ঠিক উল্টো। ছেলেটি বলেছিল, তার বাবা মফস্বল শহরের বড় ব্যবসায়ী। পরে জানা গেল, তিনি আসলে সিনেমা হলের কর্মচারী।
* মেয়েটি বলেছিল, তার মা ডাক্তার। দেখা গেল, তিনি টিকাদান কর্মসূচির স্বাস্থ্যকর্মী। এমন মিথ্যা বাগাড়ম্বর প্রেমপর্বে চলে, অভিযোগ কম নয়। তাই প্রেম স্বর্গ থেকে আসে; এমন বেকুব ধারণায় বুঁদ না হয়ে সঙ্গীর সম্পর্কে জানাশোনা উত্তম।
* প্রেম হোক, তারপরও সামাজিক খোঁজখবর ও আয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া ভালো। প্রেমের শেষে বিয়ে পারিবারিকভাবে করা গেলে সেটা ভালো।
* বিয়ের আগে পরের কমিটমেন্ট নিয়ে দুপক্ষকেই দায়িত্বশীল ও সতর্ক হওয়া ভালো। এমন প্রতিশ্রুতি না করাই ভালো, যে জন্য পরে লজ্জা পেতে বা পস্তাতে হয়।
* যোগ্যতা, কাজ, ক্যারিয়ার, অর্থকরী কাজে অংশগ্রহণ—সব রকম সংসারের জন্যই রক্ষাকবচ।
* দুই পক্ষের মা-বাবা আত্মীয়দের ভূমিকা কম নয়। এখনকার আধুনিক সমাজে প্রেম হতেই পারে। সুতরাং প্রেম যাতে সুখময় সংসারের দিকে গড়ায়, সে জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।
* প্রেম বা আনুষ্ঠানিক বিয়ে—সংসার পরিকল্পনা থাকতেই হবে। সবচেয়ে বড় প্রতিজ্ঞা হবে, আমরা ভালো থাকব। পরস্পর সুখে–দুঃখে থাকব। সব ঝড়ঝাপটা সামলাব। দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাব না।

সুলতানা আলগিন, সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *