ফয়জুল্লাহ’র মৃত্যু নিয়ে লাভ লোকসানের হিসেব?

Slider ফুলজান বিবির বাংলা বাধ ভাঙ্গা মত সম্পাদকীয়

7006b69c4d049427dca01da25f087dff-1

আমাদের সহ্যক্ষমতা অসাধারণ। অথবা আমরা মূলত পলায়নবাদী। এ সমাজে বহু অন্যায়, অনাচার আর অত্যাচার আমরা তাই মেনে নিই। কখনো নানা অজুহাতে, কখনো ভুল ধারণা থেকে, কখনো স্রেফ চোখ বন্ধ রেখে। তবু কিছু ঘটনা আমাদের বদ্ধ বিবেক আর ভোঁতা চিন্তাশক্তিতে কশাঘাত করে। পুলিশের হাতে বন্দী অবস্থায় সন্দেহভাজন জঙ্গি ফয়জুল্লাহ ফাহিম হত্যাকাণ্ড তেমনি একটি ঘটনা।
এই হত্যাকাণ্ডকে বন্দুকযুদ্ধ বলা হচ্ছে। বন্দী মানুষ কখনো যুদ্ধ বা গোলাগুলিতে অংশ নিতে পারে না। কাজেই মূলত এটি হত্যাকাণ্ডই। এই হত্যাকাণ্ডের দায় দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রকেও। সরকারকে সরাসরি দায়ী না করার জন্যই হয়তো আমাদের কিছু মানবাধিকারকর্মী কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্র নামক এক বিমূর্ত সত্তাকে এসব ঘটনার জন্য দায়ী করে চলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় রাষ্ট্র মানে সরকার, জনগণ, রাষ্ট্রের ভূমি ও সার্বভৌমত্ব। এই হত্যাকাণ্ডের দায় জনগণের বা রাষ্ট্রের ভূমি বা সার্বভৌমত্বের হতে পারে না। দায়ী করতে হলে তাই সরকারকে করতে হবে, রাষ্ট্রকে নয়।
সরকারের জিম্মায় বন্দী থাকা অবস্থায় শুধু ফয়জুল্লাহ খুন হয়নি। এমন অবস্থায় আগে খুন হয়েছে আরও বহু মানুষ। তারা জঙ্গি হতে পারে, বিএনপি-জামায়াত-শিবির হতে পারে, ঠান্ডা মাথার খুনিও হতে পারে। কিন্তু কোনো কিছুই তাদের মানুষ পরিচয়কে আড়াল করতে পারে না। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন সব মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করার কথা বলে। জঘন্য খুনিকেও সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে দোষী প্রমাণিত করে উপযুক্ত শাস্তি দিতে বলে। বঙ্গবন্ধুর মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আমরা বিচার করে শাস্তি দিয়েছি। একাত্তরের ঘাতকদেরও আমরা শাস্তি দিয়েছি বিচার করার পর। তাহলে অভিযুক্ত জঙ্গি বা ভিন্নমতাবলম্বী লোকজনদের কেন মেরে ফেলা হচ্ছে কোনো বিচার না করে? কেন তারা প্রাণ হারাচ্ছে, তারা আসলেও দোষী কি না তা নির্ণীত হওয়ার আগেই?
সরকারেরই নিযুক্ত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন: সম্প্রতি ২৩টি এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি তদন্ত চেয়েছেন, তা করা হয়নি। সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায় হত্যাকাণ্ডের তদন্ত না হলে সরকারই কিছু লুকাতে চাইছে ধরে নেওয়া কি যৌক্তিক নয়? প্রশ্ন হচ্ছে, কী লুকাতে চায় সরকার? এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে বিএনপি, জামায়াত–শিবির বা জঙ্গিরা রয়েছে এটি? নিশ্চয়ই না! তাহলে কী?
২.
ফয়জুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর এসব প্রশ্ন এখন আরও উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। ফয়জুল্লাহ জনতার কাছে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হওয়া একজন আসামি। সে সংখ্যালঘু একজন শিক্ষককে হত্যা করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর এ ধরনের ক্রমাগত আক্রমণ আমাদের চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করেছে।
যেকোনো বিচারে তাই ফয়জুল্লাহ সবচেয়ে স্পর্শকাতর একজন আসামি ছিল। যেকোনো বিবেচনায় তাকে হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে রাখা অত্যাবশ্যকীয় ছিল। বহু অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এমনকি কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মীকেও আমরা এ ধরনের সুরক্ষা দিয়ে আদালতে নিতে দেখেছি। ফয়জুল্লাহকে আদালতে নেওয়ার ক্ষেত্রে তা-ই করা হয়েছিল। এর চেয়ে তুলনামূলকভাবে বহু গুণ ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে তাকে নিয়ে সহযোগীদের গ্রেপ্তার করতে যাওয়া। সেখানে তাকে হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট কেন পরানো হলো না? কেন?
ফয়জুল্লাহ নিহত হয়েছে বুকে গুলি খেয়ে। এটি প্রমাণ করে তাকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরানো হয়নি। পুলিশ বলেছে সে তার সহযোগীদের গুলিতে নিহত হয়েছে। দুর্ধর্ষ অপরাধীদের সহযোগীদের ধরতে গেলে তারা গুলি করবে, পালানোর চেষ্টা করবে, এটি তো খুবই অনুমেয়। আগেও এটি হয়েছে আমরা শুনেছি। সব জেনে-শুনে তাকে তার জঙ্গি সহযোগীদের ধরতে অরক্ষিত অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার তাই গ্রহণযোগ্য একটিই অর্থ হতে পারে এবং তা হচ্ছে তার মৃত্যুই হয়তো কাম্য ছিল পুলিশের কাছে।
এই সন্দেহ সত্যি নয় তা অকাট্যভাবে প্রমাণের দায়দায়িত্ব শুধুই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তা যদি প্রমাণ না করা যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট সব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ ঘটনার জন্য সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে মানুষের সন্দেহ করার অধিকার রয়েছে যে ফয়জুল্লাহর মৃত্যু কাম্য ছিল সরকারের কোনো না কোনো মহলের কাছেও।

সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায় হত্যাকাণ্ডের তদন্ত না হলে সরকারই কিছু লুকাতে চাইছে ধরে নেওয়া কি যৌক্তিক নয়? প্রশ্ন হচ্ছে, কী লুকাতে চায় সরকার? এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে বিএনপি, জামায়াত–শিবির বা জঙ্গিরা রয়েছে এটি? নিশ্চয়ই না! তাহলে কী?

ফয়জুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের আর একটি মাত্র ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। তা হচ্ছে, রিমান্ডে থাকা অবস্থায় অত্যাচার–নির্যাতনে তার মৃত্যু ঘটা এবং এই হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করার জন্য বন্দুকযুদ্ধ নামক নাটক সাজানো। ফয়জুল্লাহর সত্যিকার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলে বা এই হত্যাকাণ্ডের উপযুক্ত তদন্ত হলে আমরা এ সম্পর্কে জানতে পারব। কিন্তু সাগর-রুনি থেকে নিয়ে সাম্প্রতিক তনু হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটনাগুলো দেখার পর আমার মনে হয় না উপযুক্ত তদন্ত হবে—এমন বিশ্বাস আর আছে মানুষের মনে?
আইনের একজন ছাত্র হিসেবে আমার বক্তব্য একটাই। এই হত্যাকাণ্ডের দায় সরকারের কোনো না কোনো মহলের। ফয়জুল্লাহ যদি রিমান্ডে থাকা অবস্থায় নির্যাতনে মারা গিয়ে থাকে বা যদি তাকে পুলিশই গুলি করে থাকে, তাহলে এর দায় সরাসরিভাবে পুলিশ তথা সরকারের। আর যদি সত্যি সে তার সহযোগীদের গুলিতে নিহত হয়ে থাকে, তবু এর দায় সরকারের। আমাদের পেনাল কোড অনুসারে হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে এটি জানা থাকার পর তা ঘটতে দেওয়া অপরাধমূলক নরহত্যার প্ররোচনা হিসেবে কঠোরভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফয়জুল্লাহর জঙ্গি সহযোগীদের ধরতে গেলে তারা পালানোর জন্য গুলি করতে পারে, এটি অবশ্যই পুলিশের জানার কথা। এটি জানার পরও তাকে অরক্ষিত অবস্থায় সহযোগী ধরার অভিযানে নিয়ে যাওয়া এবং মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া অবশ্যই অপরাধ।

৩.
গুপ্তহত্যা আমাদের সমাজের নতুন ব্যাধি। ক্রসফায়ার, গুম, পেট্রলবোমায় এ দেশের মানুষের নিরাপত্তা ও স্বস্তি আগেই মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, মানুষে–মানুষে বিভেদ বেড়েছে, মানবাধিকার ও আইনের শাসন বিপর্যস্ত হয়েছে। গত কয়েক মাসে গুপ্তহত্যার কারণে সমাজের সার্বিক নিরাপত্তা এমনকি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছে স্বাধীন মতের মানুষ, মসজিদের ইমাম, বিদেশি নাগরিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে, যা আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর।
এমন পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু হত্যাচেষ্টার সময় ফয়জুল্লাহ গ্রেপ্তার আমাদের নতুন করে আশান্বিত করেছিল। তার সুষ্ঠু বিচার হলে এসব হীন ঘটনার জড়িত ব্যক্তিদের অন্তত একটি অংশের মুখোশ উন্মোচিত হতো, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেত। সমাজে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো তাকে হত্যা করে কিংবা এর সুযোগ করে দিয়ে এই সুযোগটি রুদ্ধ করা হলো কেন? কার স্বার্থে করা হলো এটি? ফ্রান্সের বোমাবাজির ঘটনায় একজন সন্দেহভাজনকে জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তারের জন্য মাসের পর মাস ইউরোপব্যাপী অতিসতর্ক অভিযান পরিচালনা করেছে পুলিশ। আর আমরা জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সাফল্যের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ফয়জুল্লাহকে এভাবে হারিয়ে ফেললাম!
ফয়জুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হলে আমরা তার মৃত্যুর সত্যিকারের প্রেক্ষাপট হয়তো জানতে পারব। সে কেন মরল, আমাদের অবশ্যই তা জানা উচিত। আমাদের দেশে এখন পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর দায় নিয়ে আইন রয়েছে। দেশে বহুদিন ধরে তথ্য কমিশন ও মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। অনেকের ভাষ্যমতে, দেশের বিচার বিভাগও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। তাহলে ফয়জুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না কেন?
এই বিচারের পথে একমাত্র বাধা হতে পারে সরকারের সদিচ্ছার অভাব। তবে বাধা এলে তা দূর করার মতো সামর্থ্য আর সদিচ্ছা আমাদের বিচার বিভাগের আছে বলে আমরা আশা করি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *