জামায়াত নিষিদ্ধ কতদূর

Slider জাতীয়
untitled-8_211683
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দণ্ড কার্যকর প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সরকারের এখনও কোনো উদ্যোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধে এই দলটির বিতর্কিত ভূমিকা তো রয়েছেই, পরেও বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে অপরাধী (ক্রিমিনাল) সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিভিন্ন রায়েও আদালত জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল’ সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেন।

জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড, জামায়াতের মতাদর্শের মূল ভিত্তি যেহেতু বাংলাদেশে নয়, তাই শীর্ষ নেতাদের হারানোর পরও ওই দলটি টিকে না থাকার কোনো কারণ নেই।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজ মনে করেন, জামায়াতের অতীত ও বর্তমান তৎপরতা সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তের পরিপন্থী হওয়ায় রাজনৈতিক দল হিসেবে এ দলটি নিষিদ্ধ করা উচিত। দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী ও তার অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও নিষিদ্ধ করা যায়। এ জন্য সংবিধান সংশোধন বা নতুন আইন করার প্রয়োজন নেই। সংশ্লিষ্টরা জানান, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের

(গ) ও (ঘ) উপ-অনুচ্ছেদ, রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপল্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৭২ ও দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮-এর বিধি-বিধান অনুসরণ করে যে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নিষিদ্ধ করা যায়। দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮-এর ৩ ও ৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ববিরোধী কার্যকলাপ করতে পারবে না। কোনো রাজনৈতিক দল সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে গোপন তৎপরতা চালাতেও পারবে না।

এদিকে, সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে খসড়া আইনটি তৈরি করা হলেও গত দুই বছরে তা চূড়ান্ত করা হয়নি। এ নিয়ে একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও মন্ত্রিসভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত না হওয়ায় জামায়াতের বিচার অনেকটা এখন হিমাগারে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াত-শিবিরের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা চালায় তারা। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের আইনগত সুযোগ থাকার পরেও কোনো ব্যবস্থা নেই।

জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকারের মনোভাব ইতিবাচক। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন আপিলের নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে তারা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহল থেকেও একই মনোভাব ব্যক্ত করা হচ্ছে। তারা বলছেন, যেহেতু জামায়াত নিষিদ্ধের প্রশ্নটি আদালতে বিচারাধীন, সেহেতু আদালতের রায় অনুযায়ীই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। এতে দেশে এ নিয়ে বিতর্ক যেমন এড়ানো যাবে, তেমনি বহির্বিশ্বের চাপও মোকাবেলা করা সহজ হবে। ইতিমধ্যে আদালতের রায়ে নির্বাচন কমিশন যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দলটির নিবন্ধন বাতিল ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। একইভাবে আদালতের রায়েই জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সম্ভব হবে বলেও মনে করছেন সরকার ও দলীয় নীতিনির্ধারকরা।

জামায়াত নিষিদ্ধ প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইতিমধ্যে একই মনোভাব তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রায় দুই বছরে একাধিক সংবাদ সম্মেলনসহ সভা-সমাবেশগুলোতে একাধিকবার বলেছেন, তার সরকার এ বিষয়ে আদালতের রায় অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারাও এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুরূপ বক্তব্য দিয়ে আসছেন।

এদিকে, জামায়াত নিষিদ্ধ করা এখন ‘সময়ের ব্যাপার’ বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, অপেক্ষা করেন, ৪৫ বছর আগের অপরাধের বিচার যখন করা হচ্ছে, এটাও করা হবে। তিনি বলেন, জামায়াত ইতিমধ্যে বিভিন্ন নামে নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। যতগুলো জঙ্গি সংগঠনের নাম পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, এগুলোর মূলে রয়েছে জামায়াত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক  বলেন, ‘আমরা আইনটির সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করে অনেক আগেই মন্ত্রিসভায় জমা দিয়েছি। আশা করি শিগগিরই তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।’

খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম আশা প্রকাশ করে বলেন, সব আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের কোনো কিছুই এখন আর নেই। হাইকোর্টে তাদের নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) বাতিল হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে ব্যক্তির পাশাপাশি দলেরও বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতা গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদসহ অন্য নেতাদের বিচারে সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে, তারা একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। ওই সব রায়ে জামায়াতকে একটি অপরাধী (ক্রিমিনাল) সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা থেকে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। তাহলে বাধা কোথায়? তার মতে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে কোনো রাজনৈতিক দল বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। এ ক্ষেত্রে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে সরকারের আইনগত কোনো বাধা নেই বলে মনে করেন তিনি।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধের বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। আদালত এ বিষয়ে রায় দিলে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। গতকাল বুধবার দলের এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদও একই বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেওয়া ও তাদের পুনর্বাসন করার কাজে বিএনপি জড়িত। সময় এসেছে জামায়াতের মতো এই দলটিরও বিচার করার।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে ২১ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের পাশাপাশি নাৎসিদের সাতটি দলেরও বিচার হয়েছে। চারটি দলকে পরবর্তী সময়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একইভাবে আমাদের দেশে জামায়াতকেও নিষিদ্ধ করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, আমরা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে কয়েক বছর ধরে বলে আসছি। একাত্তরে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীরা যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তা তাদের রাজনৈতিক দল জামায়াতের সিদ্ধান্তে। তাই দল হিসেবে জামায়াতের বিচার না হলে ত্রিশ লাখ শহীদ পরিবারের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না। ব্যক্তির পাশাপাশি দলেরও বিচার করতে হবে। সরকার চাইলে যে কোনো সময় জামায়াত নিষিদ্ধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বলেন, সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করায় আইনগত বাধা নেই। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা একাত্তরে গণহত্যাসহ সাত ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে প্রসিকিউশনে আবেদন করা হয়। সে সময়কার জামায়াতের সহযোগী ১২৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করারও আবেদন জানানো হয়। তদন্ত প্রতিবেদন ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ প্রসিকিউশনে জমা দেওয়া হয়। পাশাপাশি জামায়াতের সাংগঠনিক কর্মকা ও তাদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামকে অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে নিষিদ্ধের সুপারিশও করা হয়। এ ব্যাপারে প্রসিকিউশন কাজ শুরু করলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ব্যক্তির পাশাপাশি দলের বিচার করতে হলে আইসিটি আইন সংশোধন করতে হবে। সে আইন আজও চূড়ান্ত করা হয়নি। এ কারণে জামায়াতের বিচারের কাজ বন্ধ রয়েছে। এখন সরকার যে কোনো সময় জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করতে পারে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হলে ‘যুদ্ধাপরাধী দল’ হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিও জোরালো হয়ে ওঠে। একে একে ৩১ যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ হয়েছে। দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করা হচ্ছে না। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল চেয়ে তরীকত ফেডারেশনের মহাসচিবসহ ২৫ জনের করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট এক রায়ে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেন। ফলে বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় অযোগ্য হয়ে পড়ে দলটি। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত আপিল করলেও সেই শুনানি এখনও শুরু হয়নি।

রাজাকারের শিরোমণি জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মামলার রায়ে জামায়াতকে একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, জামায়াত অপরাধী সংগঠন। একাত্তরে তাদের ভূমিকা ছিল দেশের স্বার্থের পরিপন্থী। এরপর বিভিন্ন মহল থেকে দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের দাবি জোরালো হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তদন্ত শুরু করে। কিন্তু ব্যক্তির পাশাপাশি দল বা সংগঠনের বিচারে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো না থাকায় বিষয়টি আটকে যায়। এরপর আইন মন্ত্রণালয় ব্যক্তির পাশাপাশি দল বা সংগঠনের বিচার করতে খসড়া আইনটি সংশোধন করে। মন্ত্রিসভার নীতিগত অনুমোদন না হওয়ায় তা আটকে আছে গত দুই বছর ধরে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক  বলেন, জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন। তাদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তদন্ত করে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ২০১৪ সালে প্রসিকিউশনে জমা দেওয়া হয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *