এদিকে রিভিউ আবেদন খারিজের পর ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ ও জল্লাদ প্রস্তুত করা হয়েছে। একই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে কাশিমপুর কারাগারেও। আদেশের কপি কারাগারে পেঁৗছানোর পর যে কোনো সময় দণ্ড কার্যকর করা হবে। দণ্ড কার্যকরের প্রতীক্ষা করছে সারাদেশের মানুষ। এই অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে কলঙ্কমুক্ত হতে চলেছে বাংলাদেশ।
গতকাল বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ এজলাসে বসেন। এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ডিসমিসড’। রায় প্রদানকারী আপিল বিভাগের এই বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের আদেশ
লেখা হচ্ছে। ‘দ্রুততম সময়ে’ পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার পর প্রকাশ করা হবে। এক-দুই কর্মদিবসের মধ্যে রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার দপ্তরের এক কর্মকর্তা। নিজামী এখন কাশিমপুর কারাগারের কনডেম সেলে অবস্থান করছেন। কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গতকাল দুপুরে তিনি এক ব্যান্ডের রেডিওতে রায়ের খবর শুনেছেন।
রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর গোটা জাতি এখন মুক্তিযুদ্ধের সময় যার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বে বদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল, সেই মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় দিনক্ষণ গুনছে। এ নিয়ে যুদ্ধাপরাধের মামলায় সর্বোচ্চ আদালতে সাতজনের আপিল নিষ্পত্তি হলো। রায়ের পর বিবিসি, গার্ডিয়ান, এএফপি, টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশিত হয়।
শেষ ধাপ প্রাণভিক্ষা :রিভিউ আবেদন খারিজের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী নিজামীর চূড়ান্ত আইনি লড়াই শেষ হলো। রিভিউ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাঠানোর পর সরকারের নির্দেশে কারা কর্তৃপক্ষ যেকোনো সময় দণ্ড কার্যকর করতে পারবে। তবে রায় কার্যকর করতে সর্বশেষ ধাপ রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর প্রাণভিক্ষার আবেদনপর্ব এখনও বাকি। নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধী নিজামী এখন একাত্তরে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে জীবন ভিক্ষা চাইতে পারবেন। এ বিষয়টির নিষ্পত্তির পর সরকার দ
২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে নিজামী কাশিমপুর কারাগারে আছেন। নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার প্রতিবাদে আগামী রোববার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। আজ শুক্রবার জামায়াত দোয়া দিবস ও কাল শনিবার সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের কর্মসূচি দিয়েছে। আলোচিত চট্টগ্রামে আটক দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাতেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শিল্প ও কৃষিমন্ত্রী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নিজামী বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন।
নিজামীর রিভিউ খারিজের পর কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার ও আশপাশের এলাকায় সতর্কতা বাড়ানো হয়। কারাগারের নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়।
রায়ের প্রতিক্রিয়া :রিভিউ খারিজের পর সাংবাদিকদের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এখন দণ্ডপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামি দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন। তা ছাড়া অন্য কোনো সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘এর আগে যেভাবে ফাঁসির রায়গুলো কার্যকর করা হয়েছে, সেভাবেই এ রায় কার্যকর হবে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। রিভিউয়ের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি কারাগারে যাওয়ার পর নিজামীকে তা পড়ে শোনানো হবে। এরপর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না তা নিষ্পত্তির পর কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের নির্দেশে দণ্ড কার্যকর করবে।’ তিনি বলেন, ‘একাত্তরে আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিজামী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তাই সর্বোচ্চ শাস্তিই ছিল নিজামীর প্রাপ্য।’
নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, বিশেষ উদ্দেশ্যে এ বিচার করা হচ্ছে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে একের পর এক ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করতে পারছি না। কেননা ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের দেওয়া বানানো ও শেখানো সাক্ষীর ভিত্তিতে এ বিচার করা হচ্ছে। আদালত এখানে অসহায়।’ রায় কতটা সঠিক হয়েছে ভবিষ্যতের ইতিহাস তা পর্যালোচনা করবে। তিনি আরও বলেন, ‘প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি আসামির একান্ত ব্যক্তিগত। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আসামি নিজেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।’ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ বলেছেন, নিজামীর ফাঁসির রায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ উপহার।
গতকাল আপিল বিভাগে নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের পরপরই আদালতের বাইরে ও রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও সন্তোষ প্রকাশ করে ‘বিজয় মিছিল’ বের হয়। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন। রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে বলে জানিয়েছে ১৪ দল। নিজামীর ফাঁসি দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রাম, পাবনা, রাজশাহী, বরিশাল, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার শ্রেণী-পেশার মানুষ। অভিনন্দন জানিয়ে দ্রুত রায় কার্যকর করতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার-পরিজন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় নিজামীর জন্মস্থান পাবনায় জেলা শহরে আনন্দমিছিল বের হয় এবং মিষ্টি বিতরণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলো ও সর্বস্তরের মানুষ।
২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ একাত্তরের আলবদর বাহিনীপ্রধান ও জামায়াতের সহযোগী সংগঠন তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নিজামীকে চারটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আরও চারটি অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে গত ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা ও সহযোগিতা এবং পাবনার সাঁথিয়ায় হত্যা ও ধর্ষণের দায়ে তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। প্রমাণিত এ তিন অভিযোগের মধ্যে রয়েছে_ পাবনার বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের সাড়ে ৪০০ মানুষকে হত্যা ও ৩০-৪০ নারীকে ধর্ষণ, পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী গণহত্যা। নিজামীর আপিল আংশিক মঞ্জুর করে অপর তিনটি অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
কঠোর নিরাপত্তাবলয় :আপিল বিভাগে নিজামীর রিভিউ আবেদনের রায় ঘোষণা উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্ট এলাকাকে ঘিরে গতকাল ভোর থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। অসংখ্য পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটকে ভোর থেকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ ছাড়া আপিল বিভাগে প্রবেশের মুখে আর্চওয়ে বসানো হয়। আদালত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়। যে কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় অবস্থান নেন বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।