তদন্ত ঘুরপাক খাচ্ছে একই বৃত্তে একই কায়দায় একের পর এক খুন

Slider জাতীয়

 

12064_f2

 

 

 

 

 

 

 

একটি মোটরসাইকেল। তিনজন আরোহী। হঠাৎ এসে টার্গেট করা ব্যক্তির ওপর আক্রমণ। কখনো ছুরিকাঘাতে কুপিয়ে হত্যা। কখনোবা আগ্নেয়াস্ত্র বের করে গুলি। কয়েক মিনিটের কিলিং মিশন। খুনের পর নির্বিঘ্নে পালিয়েও যাচ্ছে তারা। আরেক গ্রুপ আসছে নানা ছলনায়। ৫-৬ জনের দল। কখনো বই কেনার নামে, কখনো পার্সেল নিয়ে বা বাসা ভাড়ার কথা বলে। এসব উপায়ে বাসায় ঢুকতে না পারলে পথের কাছেই ওত পেতে থাকছে। এরা চাপাতি দিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে। সঙ্গে থাকলেও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে কেবল নিজেদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে। একের পর এক ঘটছে এরকম ঘটনা। রাজধানী থেকে মফস্বল শহর, খুনের কায়দাও প্রায় একই। প্রশ্ন উঠেছে গুপ্ত হত্যার মিশনে এরা কারা? তাদের কি উদ্দেশ্য।

কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে পারলেও মূল হোতারা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি গোয়েন্দা নজরদারি, নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলেও এই চক্রটিকে ঠেকানো যাচ্ছে না। এই চক্রের কৌশলের কাছে রীতিমতো হার মানতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। তবে এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, সমৃদ্ধ হচ্ছে, তখন ষড়যন্ত্র হচ্ছে। শুধু দেশে না, আন্তর্জাতিকভাবেও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মানুষ হত্যা করা হচ্ছে আর নাম দেয়া হচ্ছে আইএসের। আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে আমাদের দায়িত্ব খুনিদের খুঁজে বের করা। কিন্তু অনেক দেশ মায়াকান্না দেখাতে চায়।

মায়াকান্না দেখিয়ে তারা চায় আমাদের পাশে আসতে। যেভাবে এসেছিল সিরিয়াসহ অন্যান্য দেশের পাশে। সেসব দেশের অবস্থা আমরা দেখেছি। এজন্য এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। সর্বশেষ জুলহাজ হত্যাকাণ্ডের পর আইজিপি বলেন, আমরা এসব হামলার ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই রহস্য উদঘাটন করেছি। বাকিগুলোর তদন্ত চলছে। আসামিদের ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর আগে খুনিরা কারা জানতে চাইলে সম্প্রতি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সব সময় বলি, এগুলো প্রাথমিক অবস্থায় ছিল ছাত্রশিবির, তারপর জেএমবি, তারপর হরকাতুল জিহাদ, তারপর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম। এ জঙ্গি সংগঠনগুলো একের পর এক তৈরি হয়েছে। আত্মপ্রকাশ করতে চেষ্টা করছে। আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোটরসাইকেলে দাপিয়ে বেড়ানো এই খুনি চক্রটি প্রশিক্ষিত। এরা এতটাই দুর্ধর্ষ যে শরীরের কোথায় গুলি করলে বা ছুরিকাঘাত করলে মৃত্যু নিশ্চিত হবে তা তাদের জানা। এ কারণে প্রতিটি কিলিং মিশনেই সফল হচ্ছে তারা। প্রাথমিকভাবে এসব গ্রুপকে নিষিদ্ধ ঘোষিত একাধিক জঙ্গি সংগঠনের ‘স্লিপার সেল’ বলে ধারণা করছে বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, স্লিপার সেলের সদস্য হওয়ার কারণে তাদের কাছ থেকে সহযোগীদের সম্পর্কে তথ্য উদঘাটন করা যাচ্ছে না। এ কারণে মূল হোতাদের অনেকেই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তবে মূল হোতাদের কয়েকজনকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বিদেশি নাগরিক, হিন্দু পুরোহিত বা খ্রিষ্টিয়ান মিশনের ফাদার ও শিয়া মসজিদে হামলাগুলোর সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির একটি অংশ জড়িত। আর ব্লগারসহ সম্প্রতি সমকামীদের অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিন  সম্পাদক ও যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থায় কর্মরত জুলহাজ ও তার বন্ধু তনয় হত্যায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত। যদিও নিষিদ্ধ ঘোষণার পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম তাদের নাম পরিবর্তন করে আনসার আল ইসলাম ধারণ করেছে।

জানা গেছে, রাজধানীর কূটনৈতিক ও স্পর্শকাতর এলাকা গুলশানে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেল্লাকে হত্যার মাধ্যমে মোটরসাইকেলের তিন আরোহী চক্রটি তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি কথিত নাস্তিক ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যায়  নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় চাপাতি গ্রুপ। এরপর অনেকটা ধারাবাহিকভাবে কিলিং মিশন চালিয়ে যাচ্ছে তারা। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই জঙ্গি গ্রুপের মধ্যে কে বেশি আলোচনায় তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। এ কারণে এক গ্রুপ একটি হত্যাকাণ্ডের পর আরেক গ্রুপ নিজেদের অপারেশনের জন্য মাঠে নামে।

তদন্তেও একই গতি: চাপাতি গ্রুপের হামলায় রাজধানী ঢাকায় অন্তত ৯ জন ব্লগার-লেখক-প্রকাশক ও অ্যাক্টিভিস্ট নিহত হয়েছে। তারা হলো- ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল, প্রকাশক ও ব্লগার ফয়সাল আরেফিন দীপন, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমউদ্দিন সামাদ ও সর্বশেষ সমাকামীদের অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিন রূপবান সম্পাদক জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়।

এ ছাড়া ঢাকার বাইরে সিলেটে অনন্ত বিজয় দাস নামে এক ব্লগারকে চাপাতি দিয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া আরেক ব্লগার ও প্রকাশক টুটুল ও তারেক রহিম ও আসিফ মহিউদ্দিনের ওপরও হত্যার উদ্দেশ্যে পৃথক হামলা চালানো হয়। তবে সৌভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে গেছেন। মোটরসাইকেলে তিন আরোহী চক্রের হামলার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২৬টি। এসব হামলায় ২৭ জন নিহত হয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে ঢাকার গুলশানে ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা সিজার হত্যা, রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশিও কুনি হত্যা, দিনাজপুরে এক ফাদারকে হত্যা চেষ্টা, দিনাজপুরের কান্তজীউ মন্দিরে হামলা, পঞ্চগড়ে হিন্দু পুরোহিতকে হত্যা, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা, আশুলিয়া কমার্স ব্যাংক লুটের ঘটনা, আশুলিয়া পুলিশের চেকপোস্টে হামলা, গাবতলীতে পুলিশের চেকপোস্টে হামলা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক হত্যাসহ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এস ঘটনার প্রত্যেকটিতেই জেএমবি সন্দেহভাজন বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রাজধানীর অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে,  ঢাকায় ব্লগার-অ্যাক্টিভিস্ট খুন ও বিভিন্ন হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া চারটি মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে আদালতে। এগুলো হলো রাজীব হায়দার হত্যা মামলা, ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা মামলা, আসিফ মহিউদ্দিন হত্যা চেষ্টা মামলা ও পুরানো ঢাকার হোসেনি দালানের হামলার ঘটনায় আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া তদন্তাধীন রয়েছে অভিজিৎ রায়, নিলয় নীল, নাজিমউদ্দিন সামাদ, জুলহাজ ও তনয় হত্যা, খিজির খান হত্যা, মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী হত্যা ও গোপীবাগের সিক্স মার্ডারের ঘটনা। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বাদ দিয়ে অন্যগুলোর তদন্তে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও পুলিশ জড়িত বা মূল হোতাদের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারছে না। ঢাকার বাইরের ঘটনাগুলিরও একই অবস্থা। দু-একটি ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজন কিছু লোকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তবে মূল হোতারা সবাই আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা চাপাতি দিয়ে হত্যাকারী গ্রুপের সদস্যরা রাজধানী ঢাকায় সক্রিয় বেশি। আর জেএমবির যে ভগ্নাংশটি গুপ্ত হত্যায় লিপ্ত হয়েছে তারা উত্তরাঞ্চলে সক্রিয় বেশি। তবে ঢাকার বাইরে জনবহুল এলাকাগুলোতেও সক্রিয় হয়ে উঠছে তারা। জঙ্গি নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করে আসা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গি গ্রুপগুলোর সঙ্গে শিক্ষিত ও প্রযুক্তিতে দক্ষ কিছু ব্যক্তি সম্পৃক্ত হয়েছে। এ কারণে তারা খুব কৌশলে সময় নিয়ে একেকটি হামলা পরিচালনা করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা তাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করেছি। এই গ্রুপগুলোর মাস্টারমাইন্ডদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *