ভুল নকশায় ৩৬ সেতু

Slider জাতীয়
untitled-1_205218
পূর্বাচলে ভুল নকশায় তৈরি হচ্ছে ৩৬টি সেতু। এর মধ্যে ২০টি তৈরির শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ে ত্রুটির চিত্র। তারপরও আরও ১৬টি সেতু একই নকশায় তৈরি শুরু করেছে রাজউক। বাকি ২৬টি সেতুর নকশা পরিবর্তনের জন্য এখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহযোগিতা চাওয়া হবে।

প্রতিটি সেতু নির্মাণে রাজউকের ব্যয় হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা। ‘পরিকল্পিত এই নতুন শহরের’ ভুল পরিকল্পনার কারণে ভবিষ্যতে এসব সেতু ভেঙে ফেলতে হতে পারে। তখন এগুলোর নির্মাণ বাবদ ব্যয়ের ৫০০ কোটি টাকাই পানিতে যাবে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘রামপুরা ব্রিজের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। রাজউককে ওই ব্রিজটি দুইবার ভাঙতে হয়েছে।’ ব্যয় সংকোচনের লক্ষ্যে পূর্বাচলের সেতুগুলো আর্চ (বাঁকানো) হিসেবে নকশা করা হয়নি বলে তার ধারণা।

জানা গেছে, পূর্বাচল উপশহরে লেক রাখার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন, প্রকল্পের সৌন্দর্যবর্ধন, বাসিন্দাদের লেকে ভ্রমণের সুযোগ দান এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা। কিন্তু এমনভাবে সেতুগুলো তৈরি হচ্ছে, পানির স্তরের সঙ্গে সেতুর ব্যবধান মাত্র ১ মিটার। মধ্যবর্তী ওই পরিসরে ডিঙ্গি নৌকাও চলাচল সম্ভব না। ফলে আধুনিক এই আবাসিক এলাকায় লেক রাখার উদ্দেশ্যই অনেকটা ভেস্তে যেতে বসেছে।

এ প্রসঙ্গে পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পের পরিচালক এমএ আউয়ালের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পূর্বাচলে আর্চ ব্রিজ না রাখার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগে রাজউকে অনেক জ্ঞানী-গুণী প্রকৌশলী ছিলেন। তারা এটা করেছেন। এখানে আমি এক বছর হলো এসেছি। এ জন্য বিস্তারিত বলতে পারব না। আর্চ ব্রিজ করলে ব্রিজে ওঠানামার পয়েন্টের দু’পাশের প্লট মালিকদের যাতায়াতে সমস্যা হতো। হয়তো এ জন্যই সেটা করা হয়নি। আবার সব ব্রিজের ডিজাইন এক রকম হয়ও না।’

তবে উপ-প্রকল্প পরিচালক উজ্জ্বল মলি্লক জানান, সেতুগুলো রাস্তার সমান্তরালে তৈরি করায় নিচ দিয়ে নৌকা চলাচলের সুযোগ নেই। আর্চ ব্রিজে (বাঁকানো সেতু) সেই সুযোগ থাকে। প্রকল্পের কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান সেটা করেনি। পূর্বাচলের নারায়ণগঞ্জ অংশের ৩৬টি ব্রিজ সেভাবে তৈরি হলেও গাজীপুর অংশে আর্চ ব্রিজ তৈরির জন্য বুয়েটকে দিয়ে ডিজাইন করা হবে। তখন গাজীপুর অংশের বাসিন্দারা লেকে ভ্রমণ করতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ ব্যাপারে পূর্বাচল প্রকল্পের লেকের কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান লালমাটিয়ার এ ব্লকের ৭/৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের ইপিসিএল (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্টস) লিমিটেডের কার্যালয়ে গিয়ে বিষয়টি জানতে চাইলে অভ্যর্থনাকারী ভেতরে যোগাযোগ করে জানান, পূর্বাচলের কনসালট্যান্টদের কেউ আর ইপিসিতে কর্মরত নেই। কোথায় আছেন তাও জানেন না। তবে আরেকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগে ইপিসির স্বত্বাধিকারী গোলাম মোস্তফার নাম আসার পর থেকেই তারা গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন।

তবে পূর্বাচলের ভূমি অংশের কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান ডাটা এক্সের কনসালট্যান্ট প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর সমকালকে বলেন, ‘ওই সময় পূর্বাচলের মিটিংগুলোতে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ব্রিজের ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছি। বলেছি, এভাবে ব্রিজ বানালে লেক রাখার উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। এক সময় ব্রিজগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। অথচ ১-২ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করলেই ধানমণ্ডি লেকের মতো আর্চ ব্রিজ করা যেত। কেউ আমার কথা শোনেননি। বরং প্রতিবাদ করায় আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

ব্রিজ নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স নিয়াজ-উদয়ন জেভির স্বত্বাধিকারী নিয়াজ আহমেদ খান সমকালকে বলেন, রাজউকের দেওয়া ডিজাইনেই তারা ব্রিজগুলো তৈরি করছেন। ডিজাইনে পানির স্তরের সঙ্গে ব্রিজের উচ্চতা রাখা হয়েছে এক মিটার (৩ দশমিক ২৮ ফুট)।

জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জের ৬ হাজার ১৫০ একর জমিতে শুরু হয় পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পের বাস্তবায়ন। প্রকল্প এলাকায় রয়েছে ৪৩ কিলোমিটার লেক। এই লেকের ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের ৬২টি ব্রিজ। এর মধ্যে রূপগঞ্জ অংশে ৩৬টি। বাকি ২৬টি কালীগঞ্জ অংশে। ইতিমধ্যে কয়েক দফায় দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে ঠিকাদারকে ৩৬টি ব্রিজের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর নির্মাণকাজ এখন চলমান। প্রথম দফায় কার্যাদেশ দেওয়া কয়েকটির নির্মাণকাজ এখন শেষের পথে।

এ প্রসঙ্গে রাজউকের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন ভুইয়ার সঙ্গে কথা বললে তিনি বোর্ড সদস্য (পরিকল্পনা) আবদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। আবদুর রহমান সমকালকে জানান, তার জানামতে পূর্বাচলের বাসিন্দাদের নৌকায় ভ্রমণের সুযোগ করে দেওয়াই ছিল লেক রাখার অন্যতম উদ্দেশ্য। তার পরও কেন ব্রিজগুলো তৈরির সময় সে সুযোগ রাখা হয়নি, সে ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখবেন। পরে তিনি জানান, পানির লেভেলের সঙ্গে দেড় মিটার ব্যবধান রাখা হয়েছে। তার মতে, এর ফলে ছোট নৌকা চলতে পারবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের একাধিক প্রকৌশলী জানান, দেড় মিটার রাখা হয়নি। দেড় মিটার রাখলেও নৌকা চলাচল সম্ভব না। কারণ বর্ষা মৌসুমে পানির স্তর এমনিতেই উঁচুতে উঠে যায়।

এ প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব সমকালক বলেন, পূর্বাচলের মূল মাস্টারপ্ল্যানে বলা ছিল রাস্তার যোগাযোগ তো থাকবেই, পাশাপাশি লেক দিয়ে যোগাযোগেরও সুযোগ থাকতে হবে। লেকের ব্রিজের কনসালট্যান্ট সেভাবে ডিজাইন করেনি। রাজউকের দায়িত্ব ছিল সেটা বুঝে নেওয়া। তারা সেটা বোঝেনি। যে কারণে পূর্বাচলের মতো পরিকল্পিত এলাকা তৈরি হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণভাবে। ভবিষ্যতে এই ব্রিজগুলো ভেঙে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *