একই কায়দায় খুন

Slider টপ নিউজ ফুলজান বিবির বাংলা

file

 

একই কায়দায় চলছে খুন। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা। ধারাবাহিকভাবে চলছে এ হত্যাযজ্ঞ। সর্বশেষ শিকার হলেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদ। দুর্বৃত্তরা তাকে চাপাতি দিয়ে কোপানোর পর গুলিও করেছিল। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। নাজিমুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের পর আবারও আলোচানায় এসেছে ব্লগার হত্যা। নাজিমুদ্দিনসহ এ পর্যন্ত ৭ ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। শুরুটা ২০১৩ সাল। থাবা বাবা নামে পরিচিত ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার  ছিল প্রথম টার্গেট। গত বছর হত্যা করা হয়েছে মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়সহ ৫ জনকে। চলতি বছর শুরু হলো নাজিমুদ্দিনকে দিয়ে। এর পরের টার্গেট কে? এ আলোচনা এখন সর্বত্র।

ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সাতটি ঘটনার মধ্যে মাত্র দুটির খুনিদের ধরতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাকিদের খুনিরা এখনও অধরা। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে ধারাবাহিকভাবে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড বা মূল হোতারা। সর্বশেষ নাজিমুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের পর আবারও বাংলাদেশে ব্লগারদের ওপর আক্রমণের বিষয়টি উঠে এসেছে বিশ্বমিডিয়ায়। নিন্দা জানিয়েছে প্রায় সব বিশ্ব সংস্থা। এদিকে নাজিমুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ডাক দেয়া হয়েছে লাগাতার ধর্মঘটের। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন নাজিমুদ্দিন। আন্দোলন শুরু করেছে গণজাগরণ মঞ্চের ঢাকা ও সিলেটের কর্মীরা। এদিকে ঢাকার পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এখনও তারা নিশ্চিত হতে পারেননি ঠিক কী কারণে নাজিমুদ্দিনকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্মীয় বিষয়ে লেখালেখি নাকি অন্য কোনো কারণ রয়েছে, তা খতিয়ে দেখার কথা বলছেন তারা। তবে নাজিমুদ্দিনের বন্ধু ও স্বজনরা বলছেন, নাজিমুদ্দিন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতেন। ধর্ম ছিল অন্যতম একটি বিষয়। একই সঙ্গে নানারকম সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।

নাজিমুদ্দিনের বন্ধু ও স্বজনরা জানান, পরিবারের প্রায় সবাই দেশের বাইরে থাকলেও নাজিমুদ্দিন দেশেই থাকতে চেয়েছিলেন। আইনজীবী হয়ে সাধারণ মানুষের সেবা করার স্বপ্ন ছিল তার। সেই স্বপ্ন নিয়েই ঢাকায় পা রেখেছিলেন। কিন্তু দুর্বৃত্তরা তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। তিন মাস আগে সুস্থ, সবল যে যুবক ঢাকায় এসেছিলেন, তার লাশ গ্রহণ করতে হয়েছে স্বজনদের। নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও গুলি করে তাকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ফেসবুকে ও ব্লগে লেখালেখির কারণে তাকে হত্যা করা হতে পারে বলে স্বজন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা। ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করতে তাকে বারণ করেছিলেন স্বজনরা। গতকাল রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ গ্রহণ করেছেন স্বজনরা। নাজিমের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে দীর্ঘ চার ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা না হলে তারা লাগাতার কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা করেছেন।

বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় সূত্রাপুরের ইকরামপুর সড়কে দুর্বৃত্তরা গুলি ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে নাজিমুদ্দিনকে। ঘটনাস্থলের পাশে একটি সেলুন ও দর্জির দোকান রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করেই রাস্তার ড্রেনের পাশে জটলা দেখতে পান তারা। কেউ কেউ এগিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে পা বাড়ান। এ সময় গুলির শব্দ শুনতে পেয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন তারা। কেউ কেউ দোকান বন্ধ করে চলে যান। এ সময় পাঁচ থেকে ছয় যুবককে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করতে দেখা যায়। তাদের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তাদের পরনে ছিল শার্ট-প্যান্ট। মুহূর্তের মধ্যেই মানুষের ভিড়ের সঙ্গে মিশে যায় তারা। ততক্ষণে রক্তাক্ত দেহে নিথর হয়ে ড্রেনের পাশে পড়েছিলেন নাজিম। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সূত্রাপুর জোনের সহকারী কমিশনার নুরুল আমিন বলেন, দুর্বৃত্তরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে নাজিমকে হত্যা করে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচপত্র দেখে নিশ্চিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি ক্লাস শেষে মেসে ফিরছিলেন বলে জানান সহকারী কমিশনার নুরুল আমিন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতিমধ্যে কয়েকটি বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। এজন্য অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিনের ব্লগের ও ফেসবুকের বিভিন্ন লেখা, মন্তব্য ও তার ফোনের কললিস্ট যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। মৃত্যুর আগে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন নাজিমুদ্দিন। শেষ পর্যন্ত তাকেই শত শত মানুষের সামনে চলার পথে জীবন দিতে হয়েছে। মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা আগে মঙ্গলবার রাত ৯টা ১০ মিনিটে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে নাজিমুদ্দিন লিখেছিলেন, ‘সরকার, এবার একটু নড়েচড়ে বসো বাবা। দেশের যা অবস্থা, আইনশৃঙ্খলার যা অবনতি তাতে গদিতে বেশিদিন থাকা সম্ভব হবে না। জনরোষ বলে একটা কথা আছে। এটার চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে না চাইলে এক্ষুনি কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। নতুবা দিন ফুরিয়ে আসবে খুব দ্রুত।’ তার আগে ‘মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পে সর্বোচ্চ এক হাজার পাঁচ শ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এর মাধ্যমে ৭৮ লাখ ৪৪ হাজার ৪শ জন কোরআন ও নৈতিকতার শিক্ষা পাচ্ছে’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১লা এপ্রিল একটি স্ট্যাটাসে নাজিমুদ্দিন লিখেছেন, ‘যতগুলোর কথা বলছেন ততগুলো জঙ্গি আর উগ্রবাদী বের হয়ে আসবে। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষছেন! এই সাপগুলা একসময় আপনাকেই দংশন করবে এবং দংশন ও রক্তাক্ত করবে আমার বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ।’ এসব ছাড়াও ধর্ম নিয়ে নানা রকম লেখালেখি রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, একাধিক ধারণাকে সামনে রেখে তদন্ত করছে পুলিশ। ব্যক্তিগত, পারিবারিক শত্রুতা এবং জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আগে তাকে কোনো হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছে বলে পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ নেই। তবে লেখালেখির কারণে অনেকে তাকে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গত বছরের ৩১শে মার্চ নাজিমকে ‘সাবধানে থেকো’ বলে মন্তব্য করেছিলেন এক ব্যক্তি। জবাবে তিনি লিখেছেন, ‘ভয় আমার নিজেরও হয় স্যার, অকালে মরে যাওয়ার ভয়। কিন্তু কী করবো স্যার। মাথা নত করে চুপ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে এ মরাটাই বোধ হয় ভালো।’

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, নাজিমুদ্দিনের মাথার বাম দিকে কানের ওপরে গুলি করা হয়েছে। গুলিটি মাথা ভেদ করে ডান দিক দিয়ে বের হয়েছে। মাথার ডানদিকে কয়েকটি কোপ রয়েছে। কোপগুলো এত গভীর ছিল যে মাথার মগজ বের হয়ে গেছে। হাসপাতালে লাশ গ্রহণ করতে এসেছিলেন নাজিমুদ্দিনের ভাইপো জাহিদুল হক সুমন ও আরও দুই আত্মীয়। সুমন জানান, তিন মাস আগে লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন নাজিম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলএমে অধ্যয়নরত ছিলেন। নৈশকালীন ক্লাস করতেন। তার আগে সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি পাস করেন। সিলেটে জালালাবাদে বড় ভাইয়ের ছেলেদের সঙ্গে একটি বাসায় থাকতেন তিনি। ঢাকায় আসার পর গেণ্ডারিয়ার একটি মেসে থাকতেন তিনি। ওই মেসে আরও পাঁচজন থাকেন। গতকাল ওই মেসটি তালাবদ্ধ ছিল।

নাজিমুদ্দিনের স্বজনরা জানান, নাজিমুদ্দিনের মা ও বড় ভাইয়ের স্ত্রী, সন্তান ছাড়া দেশে কেউ থাকেন না। গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারের তিলপাড়া ইউনিয়নের টোকাভরাট গ্রামে থাকেন তারা। ভাইয়েরা সবাই থাকেন লন্ডনে। এক সপ্তাহ আগে নাজিমের বড় ভাইয়ের অসুস্থ স্ত্রীকে ঢাকায় মিরপুরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভাবীকে দেখতে যেতেন নাজিম। তার ভাইপো সুমন জানান, পুলিশের মাধ্যমে বুধবার রাতেই তারা জানতে পারেন নাজিমকে হত্যা করা হয়েছে। খবর পেয়ে তারা ছুটে যান। নাজিমুদ্দিন গণজাগরণের কর্মী ছিলেন কি না- তা জানেন না তার পরিবারের সদস্যরা। তবে তার নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা ছিল তাদের। এ বিষয়ে নাজিমের লন্ডন প্রবাসী বড় ভাই শামিম উদ্দিন বিবিসিকে জানান, ভাইয়ের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের আশঙ্কা ছিল। ফেসবুকে লেখালেখি না করতে প্রায়ই তাকে বারণ করতেন তিনি। তিনি বলেন, সে ঠিক কি লিখতো আমি নিজে কখনও পড়িনি, কিন্তু আত্মীয়দের মুখে শুনেছি সে ধর্ম নিয়ে লিখতো। টেলিফোনে কথা হলেই নিষেধ করতাম। পরিবারের চাপে নাজিমুদ্দিনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট কিছুদিন বন্ধ ছিল বলেও জানান তিনি।

কিন্তু নিজের নিরাপত্তা নিয়ে কখনও তেমন কোনো শঙ্কা প্রকাশ করেননি নাজিমুদ্দিন। নাজিমুদ্দিনের মৃত্যুর জন্য কাকে দায়ী করেন তিনি? বিবিসির এই প্রশ্নের জবাবে শামিম উদ্দিন বলেন, যারা মেরেছে তাদেরই দায়ী করবো… ইসলাম তো নষ্ট হয় না, মানুষ নষ্ট হয়। ফেসবুকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পরিষদের সিলেট জেলার তথ্য গবেষণা সম্পাদক হিসেবে নিজের পরিচয় তোলে ধরেছেন নাজিমুদ্দিন। এ বিষয়ে তার ভাইপো সুমন জানান, আওয়ামী লীগের সমর্থক তিনি। এর চেয়ে বেশি কিছু তাদের জানা নেই।

সিলেটের গণজাগরণের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু জানান, নাজিমকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন না তিনি। তাকে দেখেছেন বলে মনে হয় না। তবে অনেকের সঙ্গে তিনি কর্মসূচিতে আসতেন বলে শুনেছেন। তিনি এ হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের গ্রেপ্তার দাবি করেন। এদিকে সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন চন্দ্র সাহা জানান, এ ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি। নিহত নাজিমুদ্দিনের ভাই লন্ডন থেকে আসার পর মামলা হবে বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।

এদিকে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যার প্রতিবাদে লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়ক অবরোধ করেন তারা। শনিবারের মধ্যে নাজিমের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের আলটিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। অন্যথায় রোববার সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘটের ডাক পালন করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা সুজন দাস অর্ক।

এ ছাড়া খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভে শত শত সাধারণ শিক্ষার্থী অংশ নেন। পরে তারা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে জজকোর্টের সামনের সড়কে অবস্থান নেন। এ সময় পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে আদালত ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ভিক্টোরিয়া পার্কের মোড়ের সামনে অবস্থান নেন তারা। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের কারণে পুরান ঢাকার ইসলামপুর, বাংলাবাজার, সদরঘাট, বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় যান চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল।
নিহত নাজিমুদ্দিন সিলেট জেলার বিয়ানীবাজারের তিলপাড়া ইউনিয়নের টোকাভরাট গ্রামের মৃত আবদুস সামাদের পুত্র। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তার বড় ভাই জুলহাস উদ্দিন বেঁচে নেই। বাকি তিন ভাই শামীম উদ্দিন, সুনাম উদ্দিন ও জসিম উদ্দিন লন্ডনে থাকেন।

ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল হোতারা
একের পর এক মুক্তমনা ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’দের গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, শনাক্ত করতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গত ৩ বছরে ৭ জন ব্লগারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরেই ধারাবাহিকভাবে ৫ জনকে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে একজন ব্লগিংয়ের পাশাপাশি মুক্তমনা ব্লগারদের বই প্রকাশ করতেন। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নাজিমুদ্দিন সামাদ নামে এক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীকে কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকার দুটি ঘটনার তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ- ডিবি। এ দুটি ঘটনায় সরাসরি হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্তদের শনাক্ত করা গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে মূল হোতারা। ব্লগার হত্যার মাস্টারমাইন্ড বা মূল হোতাদের টিকির নাগালও পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সংস্থা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল হোতা বা মাস্টারমাইন্ডদের শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করতে না পারার কারণে ব্লগার হত্যা ঠেকানো যাচ্ছে না। কোনো কোনো ব্লগার হত্যার ঘটনায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য উদ্‌ঘাটনও করতে পারছেন না তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। যতক্ষণ পর্যন্ত মূল হোতাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্লগার হত্যা কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ব্লগার হত্যার মাস্টারমাইন্ডদের ধরতে তারা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। কিন্তু ‘কাট আউট’ বা ‘স্লিপার সেল’ পদ্ধতিে ব্লগারদের হত্যা করার কারণে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে মাস্টারমাইন্ডদের বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এবং কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আমরা ব্লগার হত্যার মাস্টারমাইন্ডদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কিছু সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের ধরতেও অভিযানও চালানো হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে প্রথম কোনো মুক্তমনা ব্লগারকে হত্যা করা হয়। ওই বছর ১৫ই ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার থাবা বাবা ওরফে আহমেদ হায়দার রাজীবকে চাপাতি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এ ঘটনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ৭ ছাত্রকে শনাক্তের পর গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। সে সময় গ্রেপ্তারকৃতরা রেদোয়ানুল আজাদ রানা নামে একজনকে তাদের নেতা হিসেবে তথ্য দিলেও গত তিন বছরে সেই রানাকে গ্রেপ্তার করতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রানা বর্তমানে পাকিস্তানে পলাতক রয়েছে। সেখান থেকেই সে ব্লগার হত্যার কলকাঠি নাড়ছে।

সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি খ্যাতিমান ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় শত শত মানুষের সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। দুর্বৃত্তদের চাপাতির কোপে আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও। ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ মার্কিন নাগরিক হওয়ায় ঘটনাটি দেশ-বিদেশে আলোড়ন তুলে। কিন্তু এ ঘটনার বছর পেরিয়ে গেলেও হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি গোয়েন্দা পুলিশ। ইতিমধ্যে অভিজিৎ হত্যা মামলায় ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এদের কেউ অভিজিৎ হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ জানান, অভিজিৎ হত্যার ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে সন্দেহভাজন হিসেবে আরও ৭ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের বিস্তারিত পরিচয় সংগ্রহ করা যায়নি। সেই চেষ্টা চলছে।

সূত্র জানায়, অভিজিৎ হত্যার এক মাসের মাথায় গত বছরের ৩০শে মার্চ তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। বাবুকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন এবং দুজন হিজড়া আরিফ ও জিকরুল্লাহ নামে দুই মাদরাসাছাত্রকে চাপাতিসহ হাতেনাতে ধরে ফেলে। পরে পুলিশ কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা মাসুম ও তাহের নামে দুজনের নাম বলে। এ ছাড়া সাইফুল নামে অপর একজন ঘটনার কয়েকদিন আগে চাপাতিসহ যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের হাতে আটক হয়। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের দলনেতা হিসেবে তাহের ও জুনায়েদ ওরফে মাসুমের নাম জানতে পারেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। তবে এ ঘটনায় মূল হোতাদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গত বছরের ১লা সেপ্টেম্বর এ ঘটনায় আদালতে পলাতক দুজনসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় গোয়েন্দা পুলিশ।

সূত্র জানায়, গত বছরের ১২ই মে সিলেটের সুবিদবাজারে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসকে। ঘটনাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি। এ ঘটনায় ইদ্রিস আলী (২৪) নামের এক আলোকচিত্র সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে মান্নান রাহী ও খায়ের নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। সিআইডি সূত্র জানায়, মান্নান রাহী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। স্বীকারোক্তিতে সে কয়েকজনের নাম বলেছে, তাদের গ্রেপ্তারের অভিযান চালানো হচ্ছে। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ হেল বাকী গত সপ্তাহে বলছিলেন, ব্লগার হত্যাকাণ্ডের নির্দেশনাগুলো একই জায়গা থেকে আসে বলে তাদের ধারণা। যারা নির্দেশনা দিচ্ছে সেই মাস্টারমাইন্ডদের গ্রেপ্তারের জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

সূত্র জানায়, গত বছরের ৭ই আগস্ট রাজধানীর উত্তর গোড়ান এলাকায় বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল নামে এক ব্লগারকে। এ ঘটনায়ও ৫-৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মূল খুনিদের গ্রেপ্তার সম্ভব হয়নি। একই অবস্থা ব্লগার ও প্রকাশক দীপন হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও। গত বছরের ৩১শে অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে ব্লগার ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে তার নিজ প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কার্যালয়ে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। একই দিন লালমাটিয়া শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে এর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টা করা হয়। দুটি ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *