প্রাথমিক তদন্তে ঘাটতি, আলামত নষ্টের চেষ্টা ছিল খুনিদের

Slider জাতীয়

index

 

 

 

 

ঢাকা : কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে যারা হত্যা করেছে, তারা আগে থেকেই তাকে অনুসরণ করত। পরিচিত ছিল বলেই তারা তনুকে ‘ধর্ষণের’ পর নিমর্মভাবে হত্যা করেছে। হত্যাকারীরা কৌশলে আলামত নষ্ট এবং পরিবর্তনের চেষ্টাও করেছে। আলামত বিশ্লেষণ করে তদন্তকারী ও ছায়া তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তারা এমনই ধারণা করছেন।

প্রাথমিক তদন্তে তনুকে উত্ত্যক্ত করার তথ্যও পাওয়া গেছে। তনুকে হত্যার আর কোনো কারণ খুঁজে পায়নি তদন্তকারীরা। তাই দেশব্যাপী চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে তনুর উত্ত্যক্তকারীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি তনুর সঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কার কার যোগাযোগ ছিল তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বুধবার একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানায়।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তনুর লাশ উদ্ধারের পর সংগৃহিত আলামতে অনেক বিষয় অস্পষ্ট রয়েছে। সুরতহাল প্রতিবেদনও ছিল দায়সারা। এ কারণে বুধবার লাশ উত্তোলন করে দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্তের সঙ্গে নতুন করে আলামত সংগ্রহ শুরু করেছে তদন্তকারীরা।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঘটনার আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করলেও বুধবার পর্যন্ত তাদের হাতে মামলার নথিপত্র পৌঁছায়নি।

বহুল আলোচিত এই মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কুমিল্লা সিআইডির পরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে। সিআইডি নিজস্ব তদন্তের পাশাপাশি ছায়া তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করছে। বুধবার পর্যন্ত এক ডজন আলামত সংগ্রহ করে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।

সিআইডির কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চলের বিশেষ সুপার (এসএস) ড. মো. নাজমুল করীম খান বলেন, ‘আমরা এখনো আলামত সংগ্রহ করছি। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত মোবাইল ফোনসহ কয়েকটি আলামত ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। অন্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকেও আমরা সহায়তা নিচ্ছি। আমরা সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে চাই।’

ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় যেখানে তনু গেছেন বা তার যাতায়াতের স্থানগুলোতে আলামত সংগ্রহ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে  এসএস ড. মো. নাজমুল করীম খান বলেন, ‘এটা নিয়ে সমস্যা নাই। আমরা সহায়তা পাচ্ছি। আগে ছায়া তদন্তকারী হিসেবে আমরা কাজ করতে পেরেছি। এবার তদন্তকারী হিসেবে আরো কাজ করব।’

একাধিক সূত্র জানায়, প্রাথমিক তদন্তে তনুর উত্ত্যক্তকারী খোঁজা হয়েছে। পরিবার শুধু পিয়াল নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের নাম জানাতে পেরেছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি পুলিশ। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি।

তনুর লাশের কাছে থেকে দুটি মোবইল ফোন উদ্ধার করা হয়। স্বজনরা নিশ্চিত করেছেন দু’টি মোবাইল ফোনই তনুর। এর মধ্যে একটি লাশ উদ্ধারের কিছু সময় আগে পর্যন্ত চালু ছিল। অন্যটি খুলে ব্যাটারি আলাদা করা হয়। চালু থাকা মোবাইল ফোনে লাশ উদ্ধারের কিছু সময় আগে তার বাবার কল ঢোকে। এই দুটি মোবাইল ফোনের কললিস্ট যাচাই করে তদন্ত শুরু হয়েছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে তনুর সঙ্গে কার কার যোগাযোগ ছিল।

চাচাতো বোন লাইজু জাহান তনুর সমবয়সী এবং বান্ধবী। ভিক্টোরিয়া কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী লাইজু ছোটবেলা থেকেই তনুদের বাসায় থাকেন। পুলিশকে তিনি জানান, পিয়াল ছাড়া কেউ কখনও তনুকে উত্ত্যক্ত করেছিল বলে জানা নেই। তবে শিক্ষার্থী পড়াতে যাওয়া আসার সময় তনু এক রকম নিচের দিকে তাকিয়ে চলতেন। হিজাব পরতেন। বলতেন, লোকজন তার দিকে ‘ক্যামন করে যেন’ তাকায়।

সূত্র জানায়, তনুর সঙ্গে কারো সম্পর্ক বা শত্রুতা ছিল কি না, সেনানিবাসের বাইরে তাকে হত্যা করে ভেতরে আনা হয়েছে কি না এবং মোবাইল ফোনে তাকে কারা উত্ত্যক্ত করেছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তনুর লাশের প্রথম সুরতহাল প্রতিবেদন করেন কোতয়ালি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, সোহাগী জাহান তনুর মাথার পেছনে আঘাত ছিল। তার মৃতদেহের পাশে মোবাইলফোন, টর্চ, পাওয়া গেছে। হিজাব ও ওড়না তার দেহের পাশে খোলা অবস্থায় ছিল। মুখে রক্ত, বাম কানের উপরের মুখের বাম পাশে সামান্য চামড়া ছুলে যাওয়া, পরনের কামিজ সামান্য ছেঁড়া ছিল বলে জানান তিনি। এছাড়া শরীরের কোথাও কোনো ক্ষত বা আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

এই তদন্ত প্রতিবেদনের বেশ কিছু ঘাটতি নিয়ে এখন কাজ করছেন তদন্তকারীরা। নাকে ও মুখে আঘাতের ধরন সম্পর্কে বর্ণনা ছিল না সেখানে। মাথার পেছনের চিহ্নটি ভারি কোনো বস্তু দিয়ে আঘাত, নাকি দেয়ালে ঠেসে দেওয়া তা স্পষ্ট নয়। ঘটনাস্থলের আলামত থেকে তদন্তকারীরা নিশ্চিত তনুকে সেখানে হত্যা করা হয়নি। কারণ বনের মধ্যে ওই স্থানে কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল না। তনুর মরদেহের পাশে কাটা চুল, স্যান্ডেল ও যে দুটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়, তা-ও নির্দিষ্ট দূরত্বে অনেকটা সাজিয়ে রাখা  ছিল। এছাড়া তনুর মরদেহ থেকে প্রায় ২০ গজ দূরে চারটি কনডমের ছেঁড়া প্যাকেট রাখা হয়, যা অস্বাভাবিক এবং সেগুলোও সাজানো বলেও ধারণা করা হচ্ছে। লাশ উদ্ধারের স্থানেই ধর্ষণের পর তনুকে হত্যা করা হয়েছে- এমন একটি ধারণা দিতেই খুনিরা কনডমের প্যাকেট সাজিয়ে রাখে। তবে সুরতহালে এসব বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই।

সূত্র জানায়, ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তনু বাসা থেকে বের হন। প্রথমে তিনি সৈনিক জাহিদুর রহমানের বাসায় প্রাইভেট পড়ান। সাড়ে ৪টার দিকে সেখান থেকে বের হয়ে পাশের সার্জেন্ট জাহিদ হোসেনের বাসায় পড়াতে যান। সেখান থেকে বের হন সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে।

সৈনিক জাহিদ ও সার্জেন্ট জাহিদ তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট সময়ে তনু তাদের বাসায় ছিলেন। কিন্তু পৌনে ৭টার পর তনু কোথায় গেছেন, তা কেউ বলতে পারছেন না। সার্জেন্ট জাহিদের বাসা থেকে যেখানে তনুর লাশ পাওয়া যায়, এ এলাকার মধ্যে টুকিটাকি ক্যান্টিন, সৈনিক ক্লাব, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এলাকায় তার যাওয়ার সুযোগ আছে। সংরক্ষিত এসব এলাকার লোকজনের সঙ্গে বলে সেখানে তনুর উপস্থিতি জানার চেষ্টা করবেন তদন্তকারীরা।

তনুর বাবা ইয়ার হোসেন ও মা আনোয়ারা বেগম তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, অলিপুরের কালভার্টে কাছাকাছি এলাকায় তনুর লাশ পাওয়া যায়। তার লাশ উদ্ধারের এক ঘন্টা আগে স্বজনরা ওই এলাকায় তনুকে খোঁজেন। তবে তখন কোনো আলামত পাননি তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *