বন্ধ হোক নৃশংসতা

Slider নারী ও শিশু
untitled-1_190415
 

 

 

 

 

‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;/জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।/চলে যেতে হবে আমাদের।/চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি-/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় শিশুর কাছে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার এই প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও দেশে যেন আজ বিপরীত চিত্র।
গত কয়েক সপ্তাহে পত্রিকার পাতায় সন্তানহারা একেকজন মা-বাবার মর্মান্তিক আর্তনাদের যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে পাঠকের চোখ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়েছে। মায়ের বুকের নিধি ‘হারিয়ে’ যাওয়ায় অনেকে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। একের পর এক এমন মর্মন্তুদ ঘটনায় সন্তানকে ঘিরে মা-বাবার রঙিন স্বপ্ন তছনছ হচ্ছে। সাজানো সংসারে নেমে আসছে অমানিশার অন্ধকার। অনেক ক্ষেত্রে ঘাতকরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বেশির ভাগ শিশুকে পারিবারিক কলহ, প্রতিহিংসা, লালসা ও অপহরণের পর খুন করে দুর্বৃত্তরা।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে নির্যাতনের পর শিশু হত্যার ঘটনা বাড়ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশে ১৩৩ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। আর ২০১৪ সালে হত্যার শিকার হয়েছিল ৯০ শিশু। এদিকে নতুন বছরের প্রথম মাসেই হত্যার শিকার হয়েছে ১১ শিশু। র‌্যাব সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে অপহরণের পর ৪৩ শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে র‌্যাব। একই সময় অপহৃত ২১০ শিশুকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। নারী-শিশু অপহরণকারী দুই হাজার ৩৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। একই সময় পাচারকারী চক্রের কাছ থেকে ৯৭ শিশুকে উদ্ধার করে র‌্যাব। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে দেশে অপহরণের পর আট শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। আর একই সময়ে অপহৃত ৭৩ শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

মানবিকবোধসম্পন্ন মানুষ এখন শিশু হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, বিক্ষোভও অব্যাহত রয়েছে। সবাই চান, আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়। অচিরেই বন্ধ হোক এই নৃশংসতা।
এ ব্যাপারে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, নানা কারণে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। শিশুদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক শিশু সনদের আদলে ২০১৩ সালে যে আইনটি করা হয়েছিল, তা শিশুদের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করার কথা থাকলেও মূলত হচ্ছে না। অসহিষ্ণু সমাজে শিশুরা ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে বড় হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ব্যক্তিগত লোভ-লালসা চরিতার্থে শিশুদের টার্গেট করা অনেক সহজ। এ ছাড়া পরিবারের কাছে সবচেয়ে বেশি স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়ে থাকে শিশুরা। তাই দুর্বৃত্তরা তাদের টার্গেট করে ফায়দা হাসিলের জন্য। যারা শিশুদের ভীতিকর অবস্থায় ফেলে, তাদের মধ্যে স্বাভাবিক ও সুস্থ মূল্যবোধ অনুপস্থিত থাকে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, যে কোনো অপহরণের অভিযোগ পাওয়ার পরই র‌্যাব গুরুত্বসহকারে বিষয়টি তদন্ত শুরু করে। আর শিশু ও নারী অপহরণের অভিযোগকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। শুধু শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে নয়, মানবিকতার জায়গা থেকেও এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত অপহৃত শিশুকে উদ্ধার করে মা-বাবার কোলে ফেরত দেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা থাকে। সেখানে সঠিকভাবে করতে পারলে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা বোঝানো কঠিন।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি নজরুল ইসলাম বলেন, যে কোনো বিপদগ্রস্ত শিশু ও তার পরিবারের পাশে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে পুলিশ। শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িত অনেক চক্রকে কৌশলে আটক করে শিশুদের উদ্ধারের পর পরিবারের কাছে দেওয়া হয়েছে। যারা শিশুদের টার্গেট করে অপরাধ করছে, তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।অপরাধ-বিশ্লেষকরা বলছেন, পাচার, মুক্তিপণ, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল, পারিবারিক-সামাজিক বিরোধের শিকার হয়ে শিশুরা প্রাণ হারাচ্ছে। এ ছাড়া শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ এবং শিশুশ্রমও তাদের বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আবার কুরুচিসম্পন্ন কিছু মানুষের বিকৃত রুচির টার্গেট হচ্ছে শিশুরা। এমনকি তুচ্ছ কারণেও অনেক শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেও শিশু অপহরণসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে। আবার সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্রের সদস্যরাও শিশুদের টার্গেট করে অপহরণ করছে। সহজেই কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ‘দুর্বল জায়গায়’ আঘাত করা অপরাধের একটি পুরনো কৌশল।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমাজ ও রাষ্ট্রে যে কোনো অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হলে শিশুদের টার্গেট করা হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো দেশেও নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঘিরে দেশব্যাপী পেট্রোল বোমা হামলায় শিশুরা দগ্ধ হয়। এমনকি দেশে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক সহিংসতায় শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সাম্প্রতিক কিছু নৃশংস ঘটনা: চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি ঝিনাইদহের শৈলকুপার কবিরপুর মসজিদপাড়ায় তিন শিশুকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। পারিবারিক কলহের জের ধরে ইকবাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি নিজের ভাই ও বোনের তিন সন্তানকে পুড়িয়ে হত্যা করে। নিহত শিশুরা হলো আমিন হোসেন (৭), সিবলু হোসেন (৯) ও মাহিম হোসেন (১৩)। আমিন হোসেন প্রথম শ্রেণী, সিবলু তৃতীয় শ্রেণী ও মাহিম সপ্তম শ্রেণীতে পড়ত। ইকবালকে প্রতিবেশীরা আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। সে সিঙ্গাপুর থাকত। সিঙ্গাপুর থেকে ভাই দেলোয়ারের কাছে সে টাকা পাঠাত। দেশে এসে এই টাকা ফেরত চায় সে। দেলোয়ার টাকা না দেওয়ায় সে তিন শিশুকে হত্যা করে।

৩০ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জ সদরের মালির পাথর এলাকার একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে নীরব (১১) নামের এক মাদ্রাসাছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নীরব মালির পাথর মাদ্রাসায় পড়ত। ২৯ জানুয়ারি খেলার সময় সে নিখোঁজ হয়। গত ১ ডিসেম্বর রংপুর নগরের আদর্শপাড়া থেকে রাহিমুল ইসলাম রণক (১১) নামের এক শিশু নিখোঁজ হয়। দুই মাস পর ২৮ জানুয়ারি মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেপানি গ্রামের একটি জমি থেকে গর্ত খুঁড়ে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যাকাণ্ডে আর্থিক লেনদেনের বিষয় জড়িত বলে পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র জানায়। শিশুটির খোঁজ পেতে তার মা একাধিকবার সংবাদ সম্মেলনও করেন।২৮ জানুয়ারি শুক্রবার ঢাকার ধামরাইয়ে শাকিল (১২) ও ইমরান (১০) নামে দুই স্কুলছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়।

টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মোড়ভাঙ্গা গ্রামের একটি লেবুক্ষেত থেকে লাশ দুটি উদ্ধার করা হয়। পুলিশ ও পরিবার বলছে, মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে তাদের হত্যা করা হয়।গত ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ২ নম্বর বাবুরাইলে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। তারা হলো শান্ত (৫) ও সুমাইয়া (৫)। ১৯ জানুয়ারি কক্সবাজারের রামুর বড়বিল গ্রামের একটি ফলের বাগান থেকে মোহাম্মদ শাকিল (১০) ও মোহাম্মদ কাজল (৯) নামের দুই সহোদরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মুক্তিপণের দাবিতে ১৭ জানুয়ারি গর্জনিয়া ইউনিয়নের বরবিল গ্রামে খেলার সময় তাদের অপহরণ করা হয়েছিল। শিশুদের বাবা মো. ফোরকান জানান, চার লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিল অপহরণকারীরা।৯ জানুয়ারি গাজীপুরের
কালিয়াকৈর উপজেলার হরতুকিচালা থেকে রাব্বী হোসেন (৩) নামের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এক মাস নিখোঁজ থাকার পর তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
গত বছর সিলেটে চুরির অভিযোগে শিশু রাজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। শিশুকে নির্যাতনের ওই ভিডিওচিত্র প্রকাশ হলে তোলপাড় শুরু হয়। প্রায় একই সময় খুলনায় আরেক শিশু রাকিবকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ওই দুটি ঘটনার বিচার অবশ্য দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *