তিন বছর পর শান্তিপূর্ণ ‘৫ জানুয়ারি’

Slider জাতীয়

images

 

 

 

 

 

ঢাকা: প্রকৃতিতে শান্ত শীতের কোমল বার্তা থাকলেও পরপর গত তিনটি ‘৫ জানুয়ারি’ দেশ ছিল রাজনৈতিক উত্তাপে উত্তাল। ২০১৩ সালের এই তারিখে উত্তাপের কারণ ছিল জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ, ২০১৪ সালে বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৫ সালে ওই নির্বাচনের প্রথম বছরপূর্তি। এসব বিষয়কে সামনে রেখে গত তিন বছরই ৫ জানুয়ারিতে ব্যাপক সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটতে দেখা গেছে। ৫ জানুয়ারি ঘিরে এবারও আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলেরই কর্মসূচি থাকার কারণে সহিংসতার আশঙ্কা করা হলেও শেষ পর্যন্ত অপ্রীতিকর কোনো ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্য দিয়েই দুই দল শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করেছে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথম বছরপূর্তিতে গতবছরের ৫ জানুয়ারি সমাবেশ করতে চেয়েছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। দিনটিকে তারা আখ্যা দিয়েছে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ বলে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ভাষায় এ দিনটি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’। এ উপলক্ষে কর্মসূচি ছিল তাদেরও। পাল্টাপাল্টি দুই কর্মসূচির মধ্যে বিকেলে সমাবেশ করতে পল্টনে যেতে চেয়ে পুলিশের বাধায় বাড়ির বাইরেই আসতে পারেননি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। প্রতিবাদে গুলশান কার্যালয়ের গেটের ভেতরে দাঁড়িয়েই দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেন তিনি। বছর ঘুরে গেলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এই অবরোধ এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি।

২০১৫ সালে বিএনপির হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে নজিরবিহীন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। যার মূলে ছিল চলন্ত বাসে পেট্রোলবোমা হামলা। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চলা এ কর্মসূচিতে কেবল পেট্রোলবোমা হামলাতেই প্রায় ৬০ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধেও নিহত হন ৪০ জনের মতো। ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে অর্থনীতি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে যা ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি। এসবের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে দোষারোপ করে আসছে। আওয়ামী লীগের ভাষ্য- নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে বিএনপির নেতাকর্মীরা এসব করেছে। অন্যদিকে বিএনপির দাবি, বিরোধীদলকে দমনের অংশ হিসেবে সরকার তাদের এজেন্টদের দিয়ে নাশকতা করেছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রহসনের নির্বাচন আখ্যা দিয়ে ওই নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। তাদের মূল দাবি ছিল, নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। অন্যদিকে বিএনপির তত্ত্বাবধায়কের দাবি অগ্রাহ্য করে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অবিচল ছিল আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে তারা সংবিধানও সংশোধন করে। সে মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে ১৫০টির বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। সংসদে প্রথমবারের মতো বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয় সাবেক সামরিক শাসক এরশাদের জাতীয় পার্টি।

ওই নির্বাচন প্রতিহত করতে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ১৮ দলীয় জোটের। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত ১৮ দলের হরতাল-অবরোধ চলাকালে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হন শতাধিক মানুষ। দু’দলের সমঝোতায় চেষ্টা-তদবির চালায় পশ্চিমা বিশ্বও। দুই দলের একগুঁয়ে বিপরীত অবস্থানে শেষ পর্যন্ত তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের ক্ষণ যত এগিয়ে আসতে থাকে বাড়তে থাকে রাজনৈতিক সহিংসতা। ভোটগ্রহণের দিন অর্থাৎ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ১১ জেলায় অন্তত ১৯ জন নিহত হন। তাদের বেশিরভাগই পুলিশের গুলিতে নিহত হন বলে গণমাধ্যমের খবর। ওই নির্বাচনকে সামনে রেখে খালেদা জিয়ার অভিযোগ ছিল, তাকে কার্যত গৃহবন্দি করে রেখেছে সরকার।

এক বছর পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতেও দেখা যায় খালেদা জিয়ার সামনে একই চিত্র। গুলশান কার্যালয় থেকে তাকে বের হতেই দেয়া হয়নি। বের হতে না পেরে কার্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছে দাঁড়িয়েই বক্তব্য দিয়ে ফিরে যান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরেই ২০১৪ ও ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সহিংসতা ঘটলেও ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারিও শান্ত ছিল না দেশ। যদিও নির্বাচনকালীন সরকার বা নির্বাচন নিয়ে বিরোধ তখন ছিল না। ২০১৩ সালের সহিংসতার মূলে ছিল জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ। প্রতিবাদ জানাতে ৬ জানুয়ারি হরতালের ডাক দিয়েছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট।

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ৬ জানুয়ারি হরতাল ডাকা হলেও ৫ জানুয়ারি বিকেল থেকেই ঢাকাতে শুরু হয়ে যায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত দশটির মতো গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। সঙ্গে ছিল ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও।

রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে দিয়ে ২০১৫ সাল শুরুর পর এপ্রিলের সিটি করোপরেশন নির্বাচনের হাওয়ায় সে উত্তাপ বেশ কমে আসে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ওই নির্বাচন নিয়েও কোনো সুখস্মৃতি নেই বিএনপির। এরপর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাভাবিক গতিতে চলেছে দেশ। বিএনপির মির্জা ফখরুল, রুহুল কবীর রিজভীর মতো শীর্ষ নেতারাও মুক্তি পান কারাগার থেকে। বছরের শেষে দলীয় প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচন রাজনীতির মাঠ সরগরম করে রাখে। এই নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হলেও দলটি অভিযোগ করেছে ‘ব্যাপক কারচুপি’র। তবে এর প্রতিবাদে সহিংস কোনো ঘটনা ঘটায়নি বিএনপি।

এরপর নতুন বছরের শুরুতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বিতীয় বছরপূর্তিকে ঘিরে আবার শুরু জয় জল্পনা-কল্পনা। কী হবে ৫ জানুয়ারি! আবার জ্বালাও-পোড়াও? দিনটিকে সামনে রেখে দুই দলই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চেয়ে পুলিশ প্রশাসনের কাছে আবেদন করে। সেখানে কেউ অনুমতি না পেলে দুই দলই আবেদন জানায় তারা নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সমাবেশ করবে। আওয়ামী লীগ প্রথমে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ ১৮টি স্পটে সমাবেশের কথা বললেও পরে জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনায় নিয়ে তা সঙ্কুচিত করে। মঙ্গলবার কেবল বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও রাসেল স্কয়ারে সমাবেশ করেছে তারা। অন্যদিকে বিএনপি সমাবেশ করেছে নয়াপল্টনে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আগেই বলেছিলেন, তারা যদি সমাবেশের অনুমতি নাও পান তবু সাংঘর্ষিক কোনো কর্মসূচি দেয়া হবে না।

এরপর দুই দলই পুলিশের শর্ত মেনে সমাবেশে করেছে। বিএনপির সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেছেন, কোনো ক্ষোভ নেই, সংলাপে আসুন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলটির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বলেছেন,  আসুন আমরা সবাই মিলে সুষ্ঠু রাজনীতির সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাই।

তিনটি বছর পর একটি ৫ জানুয়ারি গেল, যাতে কোনো গাড়ি পুড়লো না, কোনো ককটেল ফাটলো না। আগের দু’বছরের মতো নাশকতায় কারো প্রাণ গেল না। বিরোধী দল অভিযোগ করে গেল তাদের মতো করে, ক্ষমতাসীনরাও অভিযোগ করলো তাদের মতো করে। আজকের দিনটিকে একদল ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ ও অন্যদল ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ বললেও বেলা শেষে সবাই সুষ্ঠু রাজনীতির কথাই বলে গেলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *