এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার!

Slider জাতীয়

 

untitled-6_178939
 

 

 

 

 

তিনটি পদ্মা সেতু বানানো যাবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা দিয়ে। পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা এর আগের বছরের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা) অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৭৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চার ভাগের এক ভাগ। প্রায় ৮০ ভাগ অর্থই পাচার হয়েছে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য ও পরিমাণ দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) ও রফতানির ক্ষেত্রে কম মূল্য ও পরিমাণ দেখানোর (আন্ডার ইনভয়েসিং) মাধ্যমে। বাকি টাকা নানা প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে দেশের বাইরে চলে গেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক

প্রতিষ্ঠান গ্গ্নোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) অর্থ পাচার বিষয়ে সর্বশেষ রিপোর্টে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার ‘২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ পাচার’ শিরোনামের এ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আমদানিকারক ও রফতানিকারক দেশের তথ্যের মধ্যে গরমিল এবং ব্যালান্স অব পেমেন্টের ডাটার অসামঞ্জস্যতা থেকে জিএফআই অর্থ পাচারের প্রাক্কলন করে। জিএফআই বলেছে, এর বাইরেও নানা প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার হয়। তাই প্রকৃতপক্ষে তাদের হিসাবের চেয়ে বেশি অঙ্কের টাকা পাচার হয়ে থাকে।
গত এক দশকে পাচারের পরিমাণ বিবেচনায় বাংলাদেশ ২৬ নম্বরে রয়েছে। গতবারের রিপোর্টে বাংলাদেশ ছিল ৫১ নম্বরে। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে মোট ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। এ বছরগুলোয় সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদের শেষ বছরে ২০১৩ সালে।

জিএফআইর রিপোর্টে বিশ্বের ১৪৯টি উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে গত এক দশকে কী পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে বাইরে চলে গেছে, তার প্রাক্কলন করা হয়েছে। আর হিসাবের পদ্ধতিগত সংশোধনের কারণে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের আগের বছরগুলোর তথ্য সংশোধন হয়ে অনেকে বেড়েছে। জিএফআইর এ বছরের রিপোর্টের তথ্য অনুসারে, ২০১২ সালে ৫৬ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা (৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার) পাচার হয়। গত বছর প্রকাশিত রিপোর্টে এর পরিমাণ ছিল ১৭৮ কোটি ডলার বা প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। হিসাবের পদ্ধতি পরিবর্তন করায় আগের সব বছরের পাচারের অঙ্ক বেড়ে গেছে।
জিএফআইর রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং ও রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ৮৩৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আইএমএফের কাছে প্রত্যেক দেশের পাঠানো আমদানি-রফতানির ডাটা বিশ্লেষণ করে যে গরমিল পাওয়া যায়, তা থেকেই এ প্রাক্কলন করা হয়েছে। এর বাইরে অন্য প্রক্রিয়ায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ‘হট মানি আউটফ্লোজ’ নামে এ ডাটা আইএমএফের ব্যালান্স অব পেমেন্ট রিপোর্ট থেকে নেওয়া।

জিএফআইর মতে, দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তা, অপরাধী এবং কর ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ীরা বিদেশে সম্পদ স্থানান্তর করতে অর্থ পাচার করে থাকে। করের স্বর্গ হিসেবে পরিচিত দেশে বেনামি কোম্পানিতে বিনিয়োগ এবং গোপন ব্যাংক হিসাবে রাখার জন্য অর্থ পাচার করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির মতে, তাদের এই প্রাক্কলন অত্যন্ত রক্ষণশীল। কেননা, এতে সেবা খাতের লেনদেন ও অপরাধ সংঘটনের জন্য নগদ লেনদেনের মতো ডাটা থাকে না।
এদিকে গত জুন মাসে প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক রিপোর্টে দেখা গেছে, সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৪’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৪ সালের শেষে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ গচ্ছিত রয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ চার হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে সেখানে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় তিন হাজার ১৬০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পাল সমকালকে বলেন, ‘২০১২ ও ২০১৩ সালে আর্থিক খাতে বেশ কয়েকটি কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। ওই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ অনেক বাড়লেও পুরোটা বিনিয়োগে আসেনি। আমদানি-রফতানির আড়ালে এসব অর্থের একটি অংশ পাচার হয়ে থাকতে পারে। তবে এখন এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি অনেক বেড়েছে। অনলাইনে সব ধরনের তথ্য মনিটরিংয়ের পাশাপাশি অফসাইট ও অনসাইট সুপারভিশন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। পরের বছরগুলোতে মুদ্রা পাচারের প্রবণতা কমে আসবে।’
জিএফআইর রিপোর্ট বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রিপোর্টটি না পড়ে এ বিষয়ে এনবিআরের অবস্থান ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে টাকা পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। অর্থ পাচার প্রতিরোধে ইতিমধ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। ট্রান্সফার প্রাইসিং আইন হয়েছে। আগামী মাস থেকে এই আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন শুরু হবে।’
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য :বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশে শক্ত কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অনেকেই অন্য দেশে বিনিয়োগ করছেন কিংবা সেকেন্ড হোম কিনছেন। তারা ভাবেন, এভাবে বাইরে টাকা নিয়ে গেলে শাস্তি হবে না।
কেন টাকা পাচার হয়_ জানতে চাইলে তিনি বলেন, নানা কারণেই হতে পারে। তবে প্রধান কারণ অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ পরিবেশের অভাব। আবার অনেকে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দেশে রাখতে চান না।
পাচার প্রতিরোধের পন্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের মধ্যে সমন্বয় জোরদারের মাধ্যমে প্রত্যেকটি আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদারক করতে হবে। অনেক মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হলেও অর্থনীতিতে সেগুলোর প্রভাব স্পষ্ট নয়। এ রকম অবস্থায় কঠোর তদারকি করতে হবে।

অর্থ পাচার নিয়ে গবেষণা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। সমকালকে তিনি বলেন, জিএফআই সামগ্রিক প্রাক্কলন করায় বাণিজ্য-সংক্রান্ত মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে পাচারের পরিমাণ সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা পাওয়া গেল। তবে আমদানি-রফতানির বাইরেও হুন্ডির মাধ্যমে দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচার করেন।
মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ মেশিনারিজ, প্ল্যান্টসহ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির মূল্য বেশি দেখিয়ে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ পাচার করেন। এভাবে অনেকেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন। তিনি তার এক গবেষণায় এ বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে অনেকে দেশের বাইরে বিনিয়োগ করছেন কিংবা সম্পত্তি কিনছেন। এ প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে বলে তার ধারণা। তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহার ও দুর্নীতি ঠেকানোর মাধ্যমে অর্থ পাচার কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

জিএফআইর ব্যাখ্যা :জিএফআই গত বছরের রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে ১০ বছরের (২০০৩-২০১২) টাকা পাচারের তথ্য দিয়েছিল। কিন্তু এবারের রিপোর্টে সব বছরের পাচারের অঙ্ক অনেক বেশি। এই তারতম্য নিয়ে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে জিএফআইর ভারপ্রাপ্ত যোগাযোগ পরিচালক ক্রিস্টিন ক্লাউ জানান, তারা এবার প্রাক্কলনের পদ্ধতি সংশোধন করেছেন। ২০১৪ সালের রিপোর্টে জিএফআই বাংলাদেশের ডাটার সঙ্গে পুরো বিশ্বের একত্রিত ডাটার গরমিল বিবেচনায় নিয়েছিল। আর ২০১৫ সালের রিপোর্টে তারা দেশভিত্তিক গরমিল বিবেচনায় নিয়েছেন। যেমন, আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের কারণে বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে ‘এক্স’ পরিমাণ অর্থ পাচার হলো। অন্যদিকে আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ব্রিটেন থেকে ‘২ এক্স’ পরিমাণ অর্থ এ দেশে পাচার হয়ে এলো। এ দুয়ের মধ্যে নিট হিসাব করলে বাইরে পাচারের তথ্য দৃশ্যমান হবে না। তিনি জানান, যে অর্থ বাইরে গেল তার হিসাব আলাদাভাবে করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি :জিএফআইর হিসাবে, ২০১৩ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাচার হয়েছে ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮৬ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু গত এক দশকে পাচার হয়েছে এর প্রায় ৮ গুণ। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে চীন থেকে, যার পরিমাণ এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি ডলার। পাচারের তালিকায় ভারত রয়েছে চার নম্বরে। ভারত থেকে ১০ বছরে ৫১ হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের পরে রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। শীর্ষ দশে থাকা অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও নাইজেরিয়া। প্রায় দেশের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তার পরিমাণ ওই দেশে আসা বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগের চেয়ে বেশি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *