পাকিস্তানের সীমাহীন ঔদ্ধত্যের কড়া প্রতিবাদ

Slider জাতীয় সারাবিশ্ব

 

untitled-1_175537

 

 

 

 

 

দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের আপত্তিকর মন্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। এক প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, পাকিস্তান বিবৃতি দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিষ্ঠুর অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সরাসরি পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বিবৃতি এখনই প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ।

গতকাল সোমবার ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনার সুজা আলমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে বাংলাদেশের কঠোর প্রতিবাদের কথা জানিয়ে দেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মিজানুর রহমান। তার হাতে তুলে দেওয়া হয় আড়াই পৃষ্ঠার প্রতিবাদপত্র। পরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে শুধু পাকিস্তান নয়, কোনো দেশেরই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া মেনে নেবে না বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে তাদের বিবৃতির জন্য কঠোর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। তবে এ বিষয়টি দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

এদিকে, সাবেক কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলেছেন, শুধু হাইকমিশনারকে ডেকে প্রতিবাদ নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের বর্বর গণহত্যার চিত্র আরও বেশি করে তুলে ধরতে হবে। তারা বলেন, দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ায় প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তান সরকার এবং সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রমাণ করেছে, তারা একাত্তরে যেমন ছিল, এখনও তা-ই। তারা বরাবরই গণহত্যা, গণধর্ষণ, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদেরই পৃষ্ঠপোষক।

গত রোববার পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এবং পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পৃথক বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড পাকিস্তানের জন্য উদ্বেগের ও যন্ত্রণার বলে উল্লেখ করে। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পাকিস্তানি পত্রপত্রিকাও বাংলাদেশের কঠোর সমালোচনা করে।

প্রতিবাদপত্রে যা আছে: চিঠির শুরুতে বলা হয়, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিষয়ে পাকিস্তানের আপত্তিকর বিবৃতির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বড় পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন মেনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত বিচার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে এবং একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিবৃতি দিয়ে পাকিস্তান আবারও প্রমাণ করল, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত দুই মানবতাবিরোধী অপরাধী ১৯৭১ সালে সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পাকিস্তান সেই ভয়ঙ্কর গণহত্যা চালিয়ে তা অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয়নি, চুয়ালি্লশ বছর পরও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একইভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ যখন গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি মুছে দিচ্ছে, তখন পাকিস্তান সেই গণহত্যার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবাদপত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক নিয়ম, রীতি অনুসারে যথাযথ ও স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করেছে। পুরো বিচার প্রক্রিয়া উন্মুক্ত ছিল এবং অভিযুক্তরা সব ধরনের অধিকার ভোগ করেছে। এই বিচারে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না; বরং যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতেই প্রকৃত অপরাধীর সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত হয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতেই সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে আদালত রায় দিয়েছেন। এ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার কিংবা সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পেয়েছেন। কম্বোডিয়া, যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে এ সুযোগ ছিল না।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা বলে ইসলামাবাদের বিবৃতিতে যা বলা হয়েছে, তার জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়- প্রকৃতপক্ষে একাত্তরে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী মানবতার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অপরাধ সংঘটন করেন। তখন তিনি জাতীয়তাবাদী দলের নেতা ছিলেন না, তখন জাতীয়তাবাদী দলের অস্তিত্ব ছিল না। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষ জানে, মুজাহিদ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনী আলবদরের প্রধান এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন। তিনি বর্তমানে যে রাজনৈতিক দলের নেতা, সেই জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। বিবৃতিতে ওই দু’জনের সত্যিকারের রাজনৈতিক পরিচয় এবং অপরাধ সংঘটনের ভয়াবহতার বিষয়টি গোপন করা হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য না করার জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

প্রতিবাদপত্রে আরও বলা হয়, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদ নিজেরা ১৯৭১ সালে তাদের দ্বারা সংঘটিত সব অপরাধের দায়িত্ব স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন। এই আত্মস্বীকৃত অপরাধীদের পক্ষে পাকিস্তানের অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী।

বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান চুক্তি অনুযায়ী এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের সাধারণ সমঝোতা অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের দায়ে চিহ্নিত তাদের সামরিক বাহিনীর ১৯৫ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। উপরন্তু পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিন্দনীয় বিবৃতি দিয়ে সেই গণহত্যার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। পাকিস্তান কোনো অবস্থাতেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার দায় এড়াতে পারে না।

প্রতিবাদপত্রে পাকিস্তান ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে, গণহত্যার বিচারের বিরুদ্ধে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তা দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য কোনো অর্থেই মঙ্গলজনক নয়। প্রতিবাদপত্রে পাকিস্তানের আপত্তিকর বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়।

বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা যা বলেন: কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরাও পাকিস্তানের বিবৃতির কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সাবেক কূটনীতিক ও কূটনীতি বিশ্লেষক হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, পাকিস্তানের উচিত নিজের চেহারা আয়নায় দেখে নেওয়া। কারণ, একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ১৯৫ জনের বিচার তারা এখনও করেনি। গণহত্যায় তাদের সহযোগীদের বিচার করছে বাংলাদেশের জনগণ। এটা বাংলাদেশের জনগণের অধিকার।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. দেলোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, পাকিস্তান বিবৃতি দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশ যাদের বিচার করছে, তা সঠিক। কারণ, একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কারা গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল, পাকিস্তানের বিবৃতি তাদের চেহারাই সুনির্দিষ্ট করছে। তিনি বলেন, শুধু কঠোর প্রতিবাদ নয়, সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের বর্বরতা আরও বেশি করে তুলে ধরা এবং কূটনৈতিক যত উপায় আছে, তার সব ব্যবহার করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, পাকিস্তানের বিবৃতি একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা শিষ্টাচারের চরম লঙ্ঘন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *