আমরা কি চরম পরিণতির দিকে যাচ্ছি?

Slider বাধ ভাঙ্গা মত

13_1

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

২১ নভেম্বর ২০১৫,শনিবার, ১৮:০৩

সরকারের খামখেয়ালি আর প্রতিনিয়ত ভুল পদক্ষেপের দরুন আমরা হয়তো অনিবার্য করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। একটি ভুল চাপা দিতে আরো দশটা অনাকাক্সিক্ষত ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছি। ফলে সমস্যার পাল্লা আরো ভারী হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে যা হয়, বাংলাদেশে এখন তা-ই ঘটছে। সাময়িক ক্ষমতার মোহে তারা অন্ধ হয়ে যান। এমনকি নিজেরা যে অনিবার্য পতনের দিকে যাচ্ছেন, সেটা তারা টেরও পান না। এর ফলে তারা যেমন বেদনাদায়ক পরিণতির দিকে এগিয়ে যান, তেমনি কোটি কোটি মানুষকেও অপরিবর্তনীয় দুর্দশা ও দুর্ভাগ্যের দিকে ঠেলে দেয়া হয়।

আমাদের দেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর অবস্থাও তেমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা দেখতেও পাচ্ছেন না যে, তাদের কৃতকর্মের ফলে দেশে চরম সঙ্ঘাত এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো হচ্ছে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি, ক্ষমতাসীন দলের লোকদের যথেচ্ছ খুনখারাবি, লুণ্ঠন, শোষণ নির্যাতন করার অঘোষিত অধিকার, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং সর্বোপরি ধারাবাহিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা। এ ধরনের অবস্থা তখনই শুরু হয়, যখন সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ মনে করতে শুরু করে যে, রাষ্ট্রযন্ত্র তার প্রতি ন্যায়বিচার করছে না কিংবা অন্যায়ভাবে তার ওপর নির্যাতন নিপীড়ন করছে।
আর নির্মোহভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, সাম্প্রতিককালে যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের কোনো-না-কোনোভাবে সরকারের লোক বা সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে ধারণা করা হয়। আর যারা এসব হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন, তাদের নির্দিষ্ট ঠিকানা আছে কিন্তু ঘাতকেরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ তারাও এই সমাজেরই কেউ-না-কেউ। অপর দিকে, এ পর্যন্ত নিহত লেখক-ব্লগারদের কথাই ধরা যায়, তাহলেও দেখা যাবে, তাদের রয়েছে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্বাস। আর তারা যা লিখেছেন, স্বীকার করতে হয় যে, তা দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের ধর্মবিশ্বাসের বিপরীত এবং সে বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ছাড়াও এই মহলের লোকেরা তাদের বিপরীত বিশ্বাসের লোকদের নির্মূল করার জন্য অবিরাম প্রচার করে যাচ্ছেন। এই শ্রেণীর লেখক-ব্লগারদের যুদ্ধ যত না ধর্মের বিরুদ্ধে, তারচেয়ে অনেক বেশি ইসলামের বিরুদ্ধে বলেই ধর্মভীরু জনগণ মনে করে। এদের কেউ হিন্দু বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান ধর্মের বিরুদ্ধে কখনো লেখেননি। এভাবেই তারা শুধু ইসলামকেই তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন।
এ দিকে আবার গোপন থাকেনি যে, সরকার ও তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রত্যক্ষ মদদে শাহবাগে গড়ে তোলা হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। এদের উত্থানে সরকার অর্থ, খাদ্য, পানি, ভ্রাম্যমাণ টয়লেট, হাতখরচা ইত্যাদি সবই দিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল, কথিত যুদ্ধাপরাধীদের ‘ন্যূনতম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড’ করার। আর তাই ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবনের রায় দিলেও এর প্রতিবাদ করতে নগরীর কেন্দ্রস্থল ও তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতাল বন্ধ করে শাহবাগে মাসাধিককাল ধরে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ মেয়েদের লাঠিখেলার মতো ব্যাপার ছিল না।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মূল আইনে সরকারের তরফ থেকে আপিল করার কোনো বিধান ছিল না। ‘শাহবাগী’দের সন্তুষ্ট রেখে সরকার সে আইন সংশোধন করে। তখন কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে, অপরাধের মাত্রা যাই হোক না কেন তাদের চরম দণ্ড দেয়া হবে। শাহবাগীদের জড়োও করা হয়েছিল সে লক্ষ্যেই। আর শেষ পর্যন্ত যাবজ্জীবনের বিধান রদ করে দিলে ফাঁসির রায় আদায় করে তা কার্যকর করা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বিচার বিভাগকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে, বিচারে ‘জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন’ ঘটতে হবে। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, যেন শাহবাগে নানা উৎসাহ দিয়ে যাদের সমবেত করা হয়েছিল, তারাই গোটা দেশের জনগণ। আপিলে জনগণের নয়, সরকারের আকাক্সক্ষাই জয়ী হয়েছিল। কিন্তু বিচার তো ‘জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলনের বিষয়’ নয়। শাস্তি হওয়ার কথা অপরাধ অনুযায়ী।
এই শাহবাগীদের নিয়ে আদেখলেপনা কম হয়নি। বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা উঠানো হয়েছে। চাঁদা না পেলে হুমকি দেয়া হয়েছে, স্বাধীনতাবিরোধী বলে শাহবাগে নাম ঘোষণা করে দেয়া হবে। চাঁদার টাকা নিয়ে নিজেরা মারামারি করেছে। কীর্তির তো আর শেষ নেই। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ভারতীয় নট-নটী, নর্তকী-গায়েন- কত লোক। আমাদের দেশের তরুণেরা জড়ো হয়ে আনন্দ করছে, তাতে ভারতীয়দের বাবার কী। তারা কি তাদের দেশের এমন আন্দোলনে আমাদের দেশের নট-নটীদের সেখানে গিয়ে অভিনয় করতে দেবে? বক্তব্য দিতে দেবে? আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে একাত্মতা ঘোষণা করতে দেবে? না সেটা কূটনৈতিক শিষ্টাচার হবে?
এ দিকে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফেরত যাওয়ার কথা ঘোষণা করে সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী জারি করেছে। এই সংশোধনী জারির মাধ্যমে শাসক দল মানুষের অনেক মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এ ক্ষেত্রে সরকার রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে যথাযথভাবে রেখে দিয়েছে। অথচ ১৯৭২ সালের সংবিধানে এমন কোনো বিধান ছিল না। এই ধারা বহাল রাখা অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখনো সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকেরা ও শাহবাগীদের একাংশ রাষ্ট্রধর্ম অটুট রাখার বিরোধিতা করে আসছে। এর সবই হচ্ছে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য নোংরা রাজনৈতিক খেলা। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, দেশে গণতন্ত্র সুসংহত করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার কী করছে?
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সরকারের তরফ থেকে ব্যাপক উদ্যোগ ও সংলাপ প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ এর বিপরীত। জাতীয় সংসদে উপস্থিত না থাকলেও দেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পক্ষ থেকে বারবার এই সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এমন ব্যঙ্গ করে, তীব্র কটূক্তিময় ভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, আর বোধকরি এরকম আহ্বান জানানোরও পরিবেশ থাকবে না। তার সে ভাষা কোনো দেশের সরকার প্রধানের মুখে মানানসই কি না, এটা বিবেচনা করার সামর্থ্যও বোধকরি সরকারের নেই। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংস্কার প্রস্তাব সম্পর্কে বলেছেন, ‘কার সঙ্গে কথা বলব, তার গা থেকে তো মরা মানুষের গন্ধ বের হয়। তার সঙ্গে সংলাপ মানায়ও না, প্রয়োজনও নেই।’ তবে মানাক বা না মানাক, সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে, এ সংলাপটি খুবই প্রয়োজনীয়। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ-সমঝোতার অভাব, প্রতিদিন বিরোধীদলীয় ও ভিন্নমতের নেতাকর্মীদের হাজারে হাজারে কারাগারে পাঠানো, ইতোমধ্যে ৭৮ হাজারেরও বেশি নেতকর্মীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলে পচানো, আদালতে থেকে জামিন পেলেও জেলগেটে ভিন্ন মামলায় আটক দেখিয়ে ফের গ্রেফতার চলছে। এ দিকে লেখক-ব্লগারদের ওপর হামলার পর হামলা শুরু হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর। ঢাকার গাবতলী ও আশুলিয়ায় খুন হয়েছেন দু’জন পুলিশ সদস্য। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। সন্দেহজনক গাড়ি চাপায় রাজশাহীতে নিহত হয়েছেন আরো দু’জন এএসআই। এর কয়েক ঘণ্টা পরই ঢাকার কাফরুলে সেনানিবাস এলাকায় এক যুবকের চাপাতির আঘাতে আহত হয়েছেন কর্তব্যরত একজন মিলিটারি পুলিশ। এই আঘাতকে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীকের ওপর আঘাত বলে মনে করা যায়।
স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশে কোনো সেনানিবাসে এ ধরনের হামলার ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। এই হামলা একটি নতুন দিকের ওপরও আলোকপাত করছে। আর তা হলো, সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন হামলাকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এতে বাড়ছে উদ্বেগ। সেনানিবাসে এই হামলার ঘটনার পরপরই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বিএনপি ও জামায়াতকে অভিযুক্ত করে এক ঘোরালো ও চতুর বিবৃতি দিয়ে বললেন, ‘যারা মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে, তারাই সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে।’ কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের তরফ থেকে শুধু বলেছে, ‘আমরা তদন্ত করছি।’
সমাজের পচন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, এটাও তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। কারণ এখন পুলিশপ্রধান যেন সর্বত্র সব বিষয়ে কর্তৃত্ব করছেন। ঝটপট মন্তব্য করে বসেন। সেনানিবাসের ভেতরে একটি ঘটনা ঘটার কয়েক মিনিটের মধ্যেই কিভাবে সে ব্যাপারে সবার আগে নিশ্চিত হন পুলিশ প্রধান? পুলিশি রাষ্ট্রে অসম্ভব বলে কিছু নেই। অনেকেই এমনও মনে করেন যে, দায়িত্বশীল কেউ কেউ বিদেশী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন। বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ তখনই শুরু হয়, যখন দেশে একনায়কতন্ত্র চালু থাকে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী কার্যত বাংলাদেশকে একব্যক্তির স্বৈরশাসনে নিপতিত করেছে।
তবে জনগণ ভেড়ার পাল নয় যে, একজন রাখাল তাদের যে দিকে খুশি তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। তারা কাউকে অবৈধ ও জবরদস্তিমূলকভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় রাখতে সম্মত থাকে না। উল্লেখ করা যায় যে, আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এনএলডি (ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি) জনগণের ভোটে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু সামরিক সরকার তাদের দেশ পরিচালনা করতে দেয়নি। তবে এ মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবারো এনএলডি জয়লাভ করেছে আর সামরিক সরকার তাদের মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
গণতন্ত্র এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে মানুষের মুখ বন্ধ করা যায় না। ষাট ও সত্তরের দশকে পাকিস্তানি শাসকেরা যেপথে গণতন্ত্রকে চালিত করার চেষ্টা করেছিল, আওয়ামী লীগও হাঁটছে সে পথেই। আওয়ামী লীগ স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নে বিভোর। সরকার এখন ছুটছে এক মরীচিকার পেছনে। ইতিহাসে দেখা যায়, কেবল জ্ঞানী লোকেরাই অতীতকে ভবিষ্যতের পথনির্দেশ হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে পথে হাঁটছে না। আর মনেও হচ্ছে না যে, শিগগিরই তারা গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসবেন। তারা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি যে একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েম করেছিলেন, সে শাসনই কায়েম হবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে।
একদলীয় শাসন কায়েম করার ফলে আওয়ামী লীগ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। দুই দশক তারা ছিল জনপ্রত্যাখ্যাত। তারপর অতীত কৃতকর্মের জন্য জনসাধারণের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে এবং ওরকম কাজ ভবিষ্যতে আর না করার ওয়াদা করে ১৯৯০-এর মাঝামাঝি ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল আওয়ামী লীগ। তবে স্বভাব যায় না ম’লে। প্রমাণিত হয়েছে, তাদের সে ওয়াদা ছিল নিতান্তই ভেলকিবাজি আর অস্বচ্ছ এক ধাপ্পা। সেটা ছিল ছলে-বলে-কলে-কৌশলে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভের জন্য নিতান্তই সময়ক্ষেপণের কৌশল। তার ফলে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন এক সাংবিধানিক জাঁতাকলের মধ্যে পড়ে গেছে। দেশে গণতন্ত্র এখন মৃত্যুশয্যায় এবং একঝলক মুক্ত বায়ুর জন্য সে টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *