ফাঁসি স্থগিতের আহ্বান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের

Slider জাতীয় সারাবিশ্ব

102365_33

যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি অবিলম্বে স্থগিত করার দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। আজ সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাদের মামলার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পর্যালোচনার (রিভিউ) আগ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের উচিত অবিলম্বে ফাঁসির রায় স্থগিত করা।
সালাউদ্দিন ও মুজাহিদের দণ্ড নিয়ে নিরপেক্ষ বিচার সংক্রান্ত গুরুতর উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও ১৮ই নভেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট তাদের রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দেয়। এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যেসব ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেসবের বিচার ও জবাবদিহি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ বিচার প্রক্রিয়া পক্ষপাতহীন বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। পক্ষপাতদুষ্ট বিচারপ্রক্রিয়া সত্যিকারের সুবিচার দিতে পারে না, বিশেষ করে যখন মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করা হয়েছে।’
মুজাহিদ ও সালাউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ডাদেশের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) পূর্ববর্তী মামলাসমূহের মতো উদ্বেগজনক রীতি অনুসৃত হয়েছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে তাড়াহুড়ো করে প্রণীত অতীত-পর্যালোচনামূলক আইন দ্বারা, যা আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ। আরেক অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীকে দণ্ডিত করা হয়েছে সরকারি বাহিনী কর্তৃক আদালত চত্বর থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী অপহরণের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ সত্ত্বেও। ওই অভিযোগের বিষয়ে স্বাধীন তদন্তের আদেশ দিতে রাজি হয়নি আইসিটি। ২০১৫ সালের এপ্রিলে মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসি দেয়া হয়। যদিও  সাক্ষী ও নথিপত্র আদালত ইচ্ছামতো সীমিত করেছেন এবং বাদীপক্ষের সাক্ষীদের পূর্বের এবং পরের অসঙ্গতিপূর্ণ বিবৃতি প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি।
মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারও একই ধরনের অভিযোগে বিদ্ধ। সাক্ষী ও নথিপত্রের বেলায় ইচ্ছামতো সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। মুজাহিদের আইনজীবীরা নিজেদের পক্ষে ১৫০০ জন সাক্ষীর নাম জমা দিয়েছে। এদের সবাইকে সাক্ষী হিসেবে মেনে নিতে যুক্তিযুক্তভাবেই রাজি হয়নি আদালত। কিন্তু অযৌক্তিকভাবে মাত্র ৩ জন সাক্ষ্য দিতে পারবে বলে আদেশ দেন আদালত। সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেননি আদালত, বরং ইচ্ছামতো সাক্ষীদের একটি সংখ্যা বেঁধে দিয়েছেন। নিজের অধঃস্তনদের নির্যাতনে প্ররোচিত করার অভিযোগে দণ্ড দেয়া হয়েছে মুজাহিদকে। যদিও এমন কোন অধঃস্তন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়নি, সাক্ষ্যও নেয়া হয়নি। রিভিউ পিটিশনের শুনানির আগে আগে মুজাহিদের এক আইনজীবীর ঘরে অভিযান চালানো হয় এবং আটক করা হয় এ সম্পর্কিত একটি মামলার কৌঁসুলিকে। এতে ওই আইনজীবী আত্মগোপনে চলে যান।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলায়, তার অন্যত্র স্থিতির (অ্যালিবাই) সাক্ষীদের বক্তব্য গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় আদালত। আবার একই সঙ্গে তাকে অপরাধের সময় তার অন্যত্র থাকার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে বলা হয়। সরকারি কৌঁসুলিদের ৪১ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করলেও, সালাউদ্দিন কাদেরের পক্ষে মাত্র ৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে পারবে বলে সীমাবদ্ধ করে দেন আদালত। এছাড়া খবরে প্রকাশ পেয়েছে যে,  সরকার আন্তর্জাতিক ঢাকাগামী এয়ারলাইনগুলোর কাছে এক আদেশে জানতে চেয়েছে, সালাউদ্দিনের রিভিউ পিটিশনের শুনানির আগে আগে তার পক্ষের কোন সাক্ষী টিকিট কিনেছে কি না। সম্ভবত, তাদের বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা দিতেই এমনটা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ দ্য ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর)-এর একটি স্বাক্ষরকারী দেশ। এতে, অভিযুক্তদের ‘বিপক্ষে দেয়া সাক্ষীদের মতো একই শর্তের অধীনে তার পক্ষের সাক্ষীদের উপস্থিতি ও পরীক্ষা নিশ্চিত করতে পারার অধিকার দিয়েছে।
ব্রাড অ্যাডামস বলেন, বাদী ও বিবাদী পক্ষের সঙ্গে একই আচরণ করা সুষ্ঠু বিচারের একটি মূলনীতি। কিন্তু আইসিটি দৃশ্যত অভিযুক্তদের সাজা দেয়ার অতি আগ্রহ থেকে এ নীতি নিয়মিতই উপেক্ষা করেছে। এসব মামলায় অভিযুক্তদের পক্ষের সাক্ষীদের খুব ক্ষুদ্র অংশকে সাক্ষ্য দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তাদের আইনজীবীদের নিয়মিত হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের পক্ষের সাক্ষীদের শারীরিক ক্ষতির হুমকি দেয়া হয়েছে, এমনকি কিছু বিদেশী সাক্ষীকে দেশে প্রবেশে ভিসা দিতে অস্বীকার করা হয়েছে।
সরকার নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, বিচারপ্রক্রিয়া উন্নত করতে মার্কিন সরকার, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অন্যদের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে ও আইন সংশোধন করবে। কিন্তু সেসব এখনও পূরণ করা হয়নি। যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক সাবেক মার্কিন দূত স্টিফেন র‌্যাপ দীর্ঘদিন ন্যায্যবিচার নিশ্চিত করতে সরকারকে কিছু পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছেন। এ সপ্তাহে তিনি বিবৃতিতে মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদেরের মামলায় অবিচার নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বিবৃতিতে বলেন, আমি যত দিন জড়িত ছিলাম, আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল বিচার ও আপিলের মধ্যদিয়ে ভুক্তভোগী ও বেঁচে যাওয়া মানুষদের সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। যাতে করে তর্কাতীত সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, বেঁচে থাকা দায়ীদের বিচারের আওতায় নেয়া সম্ভব হয়। এ ধরনের একটি প্রক্রিয়ার জন্য, আমি আহ্বান জানিয়েছিলাম আইসিটির বিচারিক প্রক্রিয়া যাতে সর্বোচ্চ আইনি মানদণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায়। কিন্তু আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলায় সেটা হয়েছে বলে আমি মনে করি না। আন্তর্জাতিক আইনানুসারে, যা বাংলাদেশ নিজেও সমুন্নত রাখতে আবদ্ধ, এ ধরনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়ার ন্যায্যতা প্রতিপাদিত হয় না।
মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদেরের মামলাসহ আইসিটির মামলাসমূহ সুবিচারের অধিকার লঙ্ঘনে পরিপূর্ণ। সংবিধানের ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইসিটির মৌলিক ত্রুটি রয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইসিটি আইনের অধীনে অভিযুক্ত ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টের কাছে সংবিধান অনুযায়ী প্রতিকারের জন্য যেতে পারবে না। এমনকি এ ৪৮ (ক) অনুচ্ছেদের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতেও নয়।
এ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচার প্রাপ্তির অধিকার, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার অধিকার অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য আসামিদের যে অধিকার ও বিচারপ্রক্রিয়া দেয়া হয়েছে তা যুদ্ধাপরাধের এ মামলা ও পূর্বাপর একই মামলায় অভিযুক্তদের জন্য প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে আইসিটিকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়েছে এ অনুচ্ছেদ।
আইসিটির অনেক বিচার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৌঁসুলি ও বিচারকদের মধ্যকার ফাঁসকৃত আলাপন থেকে। ওই আলাপনে নিষিদ্ধ ও পক্ষপাতদুষ্ট যোগাযোগ প্রকাশ পেয়েছে। অনেক সময় যারা বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ তুলেছের তাদের বিরুদ্ধে আইসিটির প্রক্রিয়া ছিল আদালত অবমাননার মামলা দেয়া। দৃশ্যত এটি ছিল ত্রুটি ঠিক করা বা সরাসরি উত্তর দেয়ার বদলে সমালোচকদের স্তব্ধ করে দেয়ার প্রচেষ্টা। আদালতের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশের দায়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান ও দ্য ইকোনোমিস্ট ম্যাগাজিনের কর্মীদের আদালত অবমাননার দায়ে বিচার করা হয়েছে।
সহজাত নিষ্ঠুরতার কারণে যে কোন অবস্থাতেই মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। ২০০৭ সালের ১৮ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবনায় সদস্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতি মৃত্যুদণ্ডাদেশের ওপর স্থগিতাদেশ জারির আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের অনেক সদস্য রাষ্ট্রও বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ডের বিলুপ্তির পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেরও এ প্রস্তাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া উচিত।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি (ইউএনএইচআরসি) যারা আইসিসিপিআরের ব্যাখ্যা দেয়, তারা বলেছে, ‘যেসব মামলার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, সেসব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তার প্রতি দৃঢ় শ্রদ্ধার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ’। তাই পক্ষপাতদুষ্ট বিচারে দেয়া যে কোন মৃত্যুদণ্ডাদেশ হবে ন্যায়বিচারের অধিকারের লঙ্ঘন।
ব্রাড অ্যাডামস বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার বিচার যুক্তিযুক্তভাবেই চায় বাংলাদেশ। কিন্তু সুবিচার দিতে হলে ন্যায়পরায়ণতা ও সর্বোচ্চ মানদণ্ড অনুসরণের প্রতি আনুগত্য প্রয়োজন, বিশেষ করে যখন কারও প্রাণের ঝুঁকি থাকে।

এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *