রাতজাগানিয়া উৎসব শুরু

Slider ঢাকা বিনোদন ও মিডিয়া

untitled-3_173247

 

 

 

 

 

লোকসঙ্গীত বাঙালির প্রাণের স্পন্দন। ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি আর বাউল গানের সুরে মাতোয়ারা হননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এসব গান বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায় সব সময়, সবখানেই। এই গানে মিশে আছে চিরকালের মুগ্ধতা। সেই লোকগীতি, মরমি গান নিয়ে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে গতকাল শুরু হয়েছে তিন দিনের আন্তর্জাতিক উৎসব ‘ঢাকা ফোক ফেস্ট’। দেশজ ঐতিহ্য লোকসঙ্গীত বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার শুভপ্রয়াস হিসেবে প্রথমবারের মতো মেরিল নিবেদিত এই আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করেছে মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টস।

দিনের আলো ফুরিয়ে এলে নামে সন্ধ্যা। আর সেই সন্ধ্যায় জমতে থাকে হাজারো গল্প। তেমনি হাজারো গল্পের সূচনা হলো গতরাতেও। আর্মি স্টেডিয়ামে দেখা মিলল অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্যের। খোলা মাঠজুড়ে মানুষের সমাগম। হাজার হাজার শ্রোতার আগমনে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সরগরম হয়ে ওঠে আর্মি স্টেডিয়াম। সবাই যেন নিজেকে সমর্পিত করেছে সুরের দরিয়ায়। বিশাল এ সঙ্গীত আসরে অংশ নিচ্ছেন স্বাগতিক বাংলাদেশ, ভারত, পাকিন্তান, চীন ও আয়ারল্যান্ডের শতাধিক শিল্পী।

প্রথম দিনের সূচনা হয় মিনু হকের পরিচালনায় পল্লবী ড্যান্স গ্রুপের লোকজ নৃত্যের মধ্য দিয়ে। ‘নাও ছাড়িয়া দে পাল উড়াইয়া দে’, ‘ঢেউ খেলানি দিয়া নাচে গোলাপি’, ‘তোর মাদলেই তালে আমার মন ঝুমুর উঠল মেতে’সহ একগুচ্ছ গানের তালে ১৬ মিনিটের এ পরিবেশনায় নৃত্যশিল্পীরা তুলে ধরেন লোকজ ঐতিহ্য। এরপর মহান সাধক লালনের গান নিয়ে মঞ্চে আসেন লালনসম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন। পর পর গাইলেন তিনটি গান। শেষ করলেন ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ দিয়ে। ফরিদা পারভীনের হাতে উৎসব-স্মারক তুলে দেন কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমান। এর পর ছিল উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে বলেন, ‘সঙ্গীতের প্রতি আমাদের যে আকর্ষণ, তা নিয়ে গর্ব করতে পারি। লোকসঙ্গীতের এক ধরনের আন্তর্জাতিক সমতা আছে। সম্প্রতি একটি দেশে গিয়েছিলাম। সেখানে যে গান ও নাচ দেখেছি, সেটা আমাদের দেশের মতো।’ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমান। এর আগে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘নিজেদের চেনার এবং চিনিয়ে দেওয়ার কাজটি হাতে নিয়েছে এবার মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টস। লোকসঙ্গীতের অবারিত রত্নভাণ্ডার সম্পর্কে জানবে বিশ্ব এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে। নতুন প্রজন্ম এবার জানবে, চর্চা করবে লোকগান। এটাই হচ্ছে এবারকার আয়োজনের মূলমন্ত্র। আগামীতেও শিকড়সন্ধানী এ উৎসবের আয়োজন করা হবে।’

 

উদ্বোধন পর্ব শেষ হতেই আবারও গানের পালা। এবার মঞ্চে এলেন শিল্পীদম্পতি কিরণচন্দ্র রায় ও চন্দনা মজুমদার। তাদের কণ্ঠে শোনা গেল লালন ছাড়াও বাউল আবদুল করিম, রাধারমণসহ বিখ্যাত লোককবিদের গান। শিল্পীদম্পতির পরিবেশনার শুরুতেই গান পরিবেশন করেন চন্দনা মজুমদার। সূচনা করেন লালনের ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ গান দিয়ে। এরপর গাইলেন বাউল সাধক আবদুল করিমের ‘তুমি বিনে আকুল পরাণ’। এই গানের সঙ্গে সঙ্গেই যেন পুরো স্টেডিয়াম জেগে ওঠে। এই শিল্পীর তিন নম্বর গানটি ছিল রাধারমণের ‘ওই জলে যাইও না গো রাই’। রাধারমণের বহু জনপ্রিয় এ গানটি পরিবেশন সময় করার জন্য দর্শক-শ্রোতাও নিজেদের ধরে রাখতে পারেননি। বসার আসন ছেড়ে উঠে পড়েন কেউ কেউ। গানের তালে নেচে-গেয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন নানা বয়সী শ্রোতা। চন্দনা মজুমদারের গানের রেশ কাটতে না কাটতেই মঞ্চে আসেন কিরণ চন্দ্র রায়। হাতে একতারা, কোমরে বায়া (এক ধরনের ঢোলবিশেষ), পরনে গেরুয়া পোশাকে নিজস্ব স্বভাবভঙ্গিতে মঞ্চে আসেন তিনি। গাইলেন ‘তোরা আয় দেখে যা, জগৎবাসী বাংলাদেশ ঘুরে’। এরপর গাইলেন কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক গান ‘আমার মন বসে না গৃহকাজে/গৃহকাজে অন্তরে বৈরাগীর লাউয়া বাজে’। কিরণ চন্দ্র রায় তার পরিবেশনা শেষ করেন রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর লেখা ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ গানটি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। এরপর শিল্পীদ্বয়ের হাতে উৎসব-স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবুল খায়ের। ভারতের কণ্ঠশিল্পী অর্ক মুখার্জি মাঝে মধ্যেই ঢাকায় আসেন। এবার এলেন মাছরাঙা টেলিভিশন ও সান ইভেন্টসের আমন্ত্রণে। এলেন তার দল কালেক্টিভকে নিয়ে। রাত পৌনে ১০টার দিকে মঞ্চে এসে বাংলাদেশের শ্রোতাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে স্বকীয় ঢঙে গাইলেন ‘বিনোদিনী রাই’। গানের পাশাপাশি বোলচালও ছিল উপভোগ করার মতো। তার দ্বিতীয় গানটি ছিল লালনের ‘তিন পাগলে হলো মেলা’ গানের অনুকরণে ‘রসিক পাগল’। রসিক পাগলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি লোকজ গানের সমন্বয়ে গাইলেন মেডলি ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি ও ভাই আল্লাহ রসূল সব বল’। তার শেষ গান ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’ও ছিল ফিউশনপ্রধান। তবে বাড়তি পাওনা ছিল ফরাসি লোকগানের আংশিক সুর-মূর্ছনা। হোক না ভিন্ন দেশি, তার পরও শ্রোতাদের আনন্দ দিয়েছে অর্কের এই বিশেষ পরিবেশনা। পরিবেশনা শেষে ভারতের এই শিল্পীর হাতে উৎসব-স্মারক তুলে দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

রাত পৌনে ১২টার দিকে মঞ্চে আসেন রব ফকির, শফি মণ্ডল ও লাবিব কামাল গৌরব। তারা শুরুতেই পরিবেশন করেন ‘সোনার মানুষ’ গানটি। শেষ করেন ‘তোমার দয়ার বিনে গুরু’ গানটি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। তিন শিল্পীর এই যৌথ পরিবেশনা শ্রোতাদের বিশেষভাবে মোহিত করে। মুহুর্মুহু করতালিই সে কথা বলে দিচ্ছিল বার বার। পাকিস্তান থেকে এসেছেন সাঁই জহুর। তিনি শোনালেন তার জনপ্রিয় গানগুলো। প্রথম দিনের শেষ আকর্ষণ ছিল ভারতের পাপন ও তার দল দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিবেশনা। তারাও তাদের নিজস্ব ঢঙে লোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন। উপস্থাপনা করেন কণ্ঠশিল্পী তপন চৌধুরী। এদিকে উৎসবে গ্রামীণ আবহ আনতে প্রাঙ্গণ পাটকাঠি দিয়ে নান্দনিকভাবে সাজানো হয়।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন আজ শুক্রবার মঞ্চে উঠবেন এদেশের জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজ। এদিন শোনা যাবে উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল আলীমের গান। তার ছেলে আজগর আলীম, জহির আলীম ও মেয়ে নূরজাহান আলীম বাবার গান গেয়ে শোনাবেন। গানে গানে শ্রদ্ধা জানানো হবে ভাওয়াইয়া গানের রাজা আব্বাসউদ্দীনকে। তাকে উৎসর্গ করে গাইবেন নাতনি নাশিদ কামাল। উকিল মুন্সির গানের জন্য বিশেষ খ্যাতি রয়েছে বারী সিদ্দিকীর। গাইবেন তিনিও। দ্বিতীয় দিনের বড় আকর্ষণ পবন দাস বাউল। ভারতের এই বাউল পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। বাংলাদেশে তার অগণিত ভক্ত-শ্রোতা।
সংশোধনী :গতকাল সমকালের শেষ পৃষ্ঠায় ঢাকা ফোক ফেস্টের খবরের সঙ্গে যে অর্ক মুখার্জির ছবি ছাপা হয়েছে, তিনি আসলে উৎসবে যোগ দেওয়া শিল্পী অর্ক মুখার্জি নন। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *