আল কুরআনের ভুল ব্যাখায় ব্লগার হত্যা

Slider জাতীয়

2015_11_08_13_40_54_VdHcVfjCFIV0XmMhkryU1P2Ke1TrZ4_original

 

 

 

 

ব্লগার হত্যায় উৎসাহ প্রদানে জঙ্গিরা সুকৌশলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ইসলামের নামে তাদের ভ্রান্ত মর্তাদশগুলোর অভিও ভিডিও এবং বই পুস্তক ইন্টারনেটে খুবই সহজলভ্য। ফলে ব্লগার হত্যায় উৎসাহী যে কোনো ব্যক্তি খুব সহজে তা ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করতে পারে। জঙ্গিদের মতাদর্শ সম্বলিত বই পুস্তক ইন্টারনেটে সহজলভ্য হওয়ায় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। গত কয়েকদিন ইন্টারনেটে এ সম্পর্কিত কয়েকটি সাইট ভিজিট করার পর আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, জঙ্গিরা জাল হাদীসের পাশাপাশি আল কুরআনের আয়াতেরও ভুল ব্যাখা প্রদান করে তরুণ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ব্লগার হত্যায় উৎসাহিত করছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ব্লগার হত্যার বৈধ এই বিষয়টি প্রমাণে তারা প্রধানত সূরা নিসার, মায়িদা ও আনফালের যথাক্রমে ৮৯-৯৩, ৩৩ ও ১২ নং আয়াতগুলোর রেফারেন্স ব্যবহার করছে। ব্লগার হত্যাকারীরা এই আয়াতগুলোর যে ব্যাখা প্রদান করছে তাতে আয়াতের প্রকৃত ব্যাখার প্রতিফলন নেই। আশা করি সূরা আনফালের ১২ নং আয়াত আলোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

“স্মরণ কর, তোমাদের প্রতিপালক ফিরিশতাগনের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন, ‘আমি তোমাদের সহিত আছি, সুতরাং মুমিনদেরকে অবিচলিত রাখ; যাহারা কুফরী করে আমি তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করিব, সুতরাং তাদের স্কন্ধে ও সর্বাংগে আঘাত কর।” (সূরা আনফাল: আয়াত ১২)।

এ আয়াতের যারা কুফরী করে অর্থাৎ কাফেরদের স্কন্ধে বা ঘাড়ে আঘাত করার কথা বলা হয়েছে দাবি করে জঙ্গিরা ব্লগারদের হত্যা করছে। কিন্তু পুরো আয়াত আলোচনা করলে দেখা যাবে তাদের ওই দাবি সত্য নয়। এ আয়াত নাযিল হয়েছিল বদর যুদ্ধকে কেন্দ্র করে।[আয়াতের একেবারে প্রথম শব্দদ্বয়ে “স্মরণ কর” উল্লেখ থাকায় স্পষ্টত বোঝা যায় আয়াতটি বদর যুদ্ধের পরে (তাফসীর ও সীরাত গ্রন্থ মতে অব্যবহিত পরে) নাযিল হয় এবং মহান আল্লাহ যে, বদর যুদ্ধে তার প্রতিশ্রুতি ফেরশতা প্রেরণ করে মুসলিমদের সাহায্য করেছিলেন সেই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।]

বদর যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল তা প্রায় সব তাফসির গ্রন্থেই উল্লেখ রয়েছে। তারপরও যদি কেউ প্রশ্ন উত্থাপণ করেন যে, বদর যুদ্ধের প্রেক্ষিতে যে নাযিল হয়েছে তাফসীরের এই কথা সত্য নয়। তবে তার জ্ঞাতার্থে বলছি এই আয়াত যে পরিস্থিতিতেই নাযিল হোক না কেন তা যুদ্ধাবস্থায় বা মুসলিমদের প্রতিপক্ষ সশস্ত্র অবস্থায় ছিল সেই সময় নাযিল হয়েছে সেই বিষয়টি সত্য। কারণ আয়াতের মধ্যেই সেই বিষয়টি স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে।

মহান আল্লাহ ফেরশতাদের নির্দেশ দিচ্ছেন মুমিনদেরকে অবিচলিত রাখতে। এই বক্তব্য থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। কারণ হঠাৎ এমন কি ঘটল যে মুমিনরা বিচলিত হয়ে পড়ছেন? মহান আল্লাহর ফেরেস্তা প্রেরণ করে তাদেরকে অবিচলিত রাখতে হচ্ছে? মুমিনদের বিচলিত হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়। বদর প্রান্তরে কাফেরদের সশস্ত্র অবস্থানের প্রেক্ষিতে এবং মুসলিমদের তুলনায় কাফেরদের সৈন্য সংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্র বেশি হওয়া কারণে মুসলমানরা বিচলিত হয়ে পড়েছেন।

তাহলে বদর যুদ্ধের প্রেক্ষিতে এই আয়াত নাযিল হয়েছিল সেই বিষয়টি যারা মেনে নিয়েছেন তারা নিঃসন্দেহে আয়াতের পরের অংশও বুঝতে পেরেছেন। তারপরও যারা বোঝেননি তাদের জন্য বলছি। “তাদের স্কন্ধে ও সর্বাংগে আঘাত কর”—- কাদের আঘাত করতে বলা হচ্ছে? যেসমস্ত কাফেররা বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে তাদেরকে আঘাত করতে বলা হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কাফেরদের আঘাত কে বা কারা করবে? এই প্রশ্নের উত্তরও সহজ। কারণ আয়াতের প্রথমে বলা আছে একথাগুলো বলা হয়েছিল ফেরেশতাদের উদ্দেশ্য করে [“তোমাদের প্রতিপালক ফিরিশতাগনের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন”]। এখানে ফেরেশতাদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এখন যদি কোনো মানুষ নিজেকে ফেরেশতা মনে করে তাহলে আমার বলার কিছু নেই।

এক কথায় যদি বলি তাহলে পুরো বিষয়টা দাড়াচ্ছে: বদর প্রান্তরে কাফেরদের সশস্ত্র অবস্থানের কারণে মুসলিমরা বিচলিত হয়ে পড়েছিল। তখন মহান আল্লাহ ফেরশতাদের প্রেরণ করে নির্দেশ দিচ্ছেন তোমরা মুসলিমদের মনবল অটুট রাখ যাতে তারা বিচলিত না হয়। ব্লগার হত্যাকারীরা নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে। কিন্তু এ আয়াতের মাধ্যমে নিরস্ত্র মানুষ হত্যার বৈধতা দেয়ার সুযোগ নেই। এ আয়াতে যে সব কাফের মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করছে তাদের ঘাড়ে আঘাত করার কথা বলা হয়েছে। এ আয়াতের কোথায় নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার কথা বলা হয়েছে সেই প্রশ্ন রাখছি?

অন্য একটি বিষয় মনে রাখতে হবে কাফেররা সশস্ত্র অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও ফেরশতাদের হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়নি। তাদেরকে আঘাত করতে বলা হয়েছে। আঘাত করা আর হত্যা বা কতল করার নির্দেশ দেয়া এক কথা নয়। ব্লগার হত্যার বৈধতায় জঙ্গিদের প্রচারিত আল কুরআনের অন্য আয়াতগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, ওই আয়াতগুলোর মাধ্যমেও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার কথা কোথাও বলা হয়নি। ইসলামের দৃষ্টিতে কেবলমাত্র আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে অস্ত্রধারণ করা এবং প্রাণরক্ষার্থে শত্রুকে হত্যার অনুমোদন রয়েছে।

ইসলাম ধর্মে মানুষ হত্যা নয়, মানুষের জীবন রক্ষাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইমাম আহমদ (র.)…. আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা.) হতে বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা.) বলেন: একদা হযরত হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট গিয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি কাজ বলে দেন যাতে আমার জীবন সুখের হয়। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে হামযা! মানুষের জীবন রক্ষা করা কি আপনি পছন্দ করেন, না হত্যা করা আপনি পছন্দ করেন? উত্তরে তিনি বললেন, মানুষের জীবন রক্ষা করা আমি পছন্দ করি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তা হলে আপনি এই কাজ করতে থাকুন। (তাফসীরে ইবন কাছীর, পৃ. ৫১৪)।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু এই কথা বলে ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয়, ব্যক্তিজীবনে বাস্তব জীবনে তার চর্চা করেছেন। বদর যুদ্ধ তার বড় প্রমাণ। যে কাফেররা দিনরাত্রি মহান আল্লাহ ও তার রাসূলকে গালি দেয়, যে কাফেররা মহান আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে অস্ত্র ধারণ করে। যুদ্ধের ময়দানে মহান আল্লাহর প্রিয় ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর একনিষ্ট সাহাবীদের হত্যা করেন। সেই সব শত্রুরা যখন বদর যুদ্ধে বন্দী হলেন তাদের কাউকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হত্যা করেননি। বরং তাদের সাথে তিনি যে আচরণ করেছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল।

ব্লগারদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করে হত্যা করা হচ্ছে, বদর যুদ্ধে বন্দী হওয়া ৭০ জন কাফের সেই দোষে দোষী ছিল। এছাড়া বদর যুদ্ধে তাদের উপর অতিরিক্ত অপরাধ ছিল:
১. মহান আল্লাহ ও তার নবীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অস্ত্র ধারণ করা।
২. আর একটি অপরাধ তাদের উপর দেয়া অসত্য হবে না। তা হল বদর যুদ্ধে যে ১৪ জন সাহাবী শহীদ হয়েছিল তাদের হত্যার বা হত্যার সহযোগিতা করার অপরাধ। কারণ ওই সব সাহাবীরা কাফের যোদ্ধাদের হাতেই শহীদ হয়েছিলেন।

এতগুলো অপরাধ সত্ত্বেও মহানবী (সা.) তাদের কাউকে প্রাণদণ্ড দিলেন না। বরং তিনি তাদের সাথে এমন আচরণ করলেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মক্কায় ফিরে যেয়ে ওই সব বন্দী কাফেররা মক্কাবাসীদের বলেছিল: “মদীনাবাসীরা (মুসলিমরা) সুখে থাক। তাহারা নিজেরা পায়ে হেঁটে আমাদেরকে উঠে চড়তে দিয়েছে। আটা যখন ফুরিয়ে আসে তখন তারা শুধু খেজুর খেয়েছে আর আমাদেরকে রুটি খেতে দিয়েছে।”

পরিশেষে, বদর যুদ্ধ কেন্দ্রিক এ ঘটনায়ই বলে দিচ্ছে ইসলাম ধর্মে ইসলাম ধর্ম অবমাননা, মহানবীকে (সা.)গালি বা কটুক্তি করাসহ প্রভৃতি অভিযোগ উত্থাপন করে নিরস্ত্র মানুষ হত্যার সুযোগ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *