‘বড়ভাই’ও গোয়েন্দাজালে

Slider বাংলার আদালত

 

untitled-1_169926_169944

 

 

 

 

 

ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কাইয়ুম কমিশনারের ছোটভাই এম এ মতিনের নির্দেশে তিন ভাড়াটে খুনি ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলাকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে গোয়েন্দা সূত্র। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কিলিং মিশনে সরাসরি জড়িতদের কাছে এম এ মতিন ‘বড়ভাই’ হিসেবে পরিচিত। তিনি গোয়েন্দাজালে রয়েছেন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তিন কিলারকে টাকার বিনিময়ে ভাড়া করেন মতিন। তবে অন্য কোনো ‘রাঘববোয়াল’ পরিকল্পনাকারী হিসেবে এর নেপথ্যে রয়েছে কি-না, এ বিষয়ে নিবিড়ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে।
তাভেলা হত্যার ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গতকাল সোমবার সকালে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে সরকারকে চাপে ফেলতে পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলাকে হত্যা করা হয়েছে। এক ‘বড়ভাই’য়ের নির্দেশে টাকার বিনিময়ে তিন ভাড়াটে খুনি সরাসরি হত্যায় অংশ নেয়। এ ঘটনার সঙ্গে আইএসের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাভেলাকে হত্যার ২৮ দিন পর চারজনকে গ্রেফতারের বিষয়টি গণমাধ্যমকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাল পুলিশ।
তবে কিছুদিন ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়, ‘অল্প সময়ের মধ্যে খুনিরা ধরা পড়বে।’ পুলিশের দাবি, গত রোববার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাভেলা হত্যায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো- রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল ওরফে বিদ্যুৎ রাসেল (৩৪), মিনহাজুল আরিফিন রাসেল ওরফে ভাগ্নে রাসেল ওরফে কালা রাসেল, তামজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে শুটার রুবেল (২৮) ও শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফ (২৯)। তাভেলাকে গুলি করেছিল শুটার রুবেল। হত্যার পর রাসেল, মিনহাজুল ও রুবেল মোটরসাইকেলে করে দ্রুত পালিয়ে যায়। কিলিং মিশনে ব্যবহৃত এফজেড মডেলের যে মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করা হয়েছে, তা-ও গণমাধ্যমকে দেখানো হয়। সেটির মালিক শরীফ।
তাভেলা হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার চার আসামির মধ্যে তিনজনের আট দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আসামি শুটার রুবেল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সোমবার দুপুরে তাভেলা হত্যা মামলায় চাক্কি রাসেল, মিনহাজুল ও শরীফকে মহানগর হাকিম আদালতে হাজিরের পর ১০ দিন করে রিমান্ড চাইলে মহানগর হাকিম মো. মাহবুবুর রহমান আট দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সূত্র বলছে, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শুটার রুবেল জানায়, আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তাকে বিদেশি গুলি করতে বলা হয়েছিল।
ডিএমপি কমিশনারের সংবাদ সম্মেলন :ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, তাভেলা হত্যার টার্গেট পরিকল্পনাকারীদের ছিল না। পশ্চিমা দেশের সাদা চামড়ার যে কোনো এক বিদেশিকে হত্যার জন্য কথিত ‘বড়ভাই’ তাদের সঙ্গে চুক্তি করে। হত্যার আগে চুক্তির অর্ধেক টাকা দেওয়া হয়। ওই ‘বড়ভাই’কে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তাকে গ্রেফতার করা গেলে এর পেছনে মদদদাতা আর কারা রয়েছে, তা-ও জানা যাবে। এতে আরও কারা লাভবান হয়েছে, তা-ও বেরিয়ে আসবে। টাকার অঙ্কের ব্যাপারে তিনজনের কাছে তিন ধরনের বক্তব্য শোনা গেছে।

ডিএমপি কমিশনার দাবি করেন, এ হত্যার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল, দেশ ও সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে ফেলা। বিদেশিদের কাছে এই বার্তা দেওয়া, ‘বাংলাদেশে তারা নিরাপদ নন।’ এ ঘটনার সঙ্গে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার নূ্যনতম কোনো তথ্য-প্রমাণ ও আলামত পাওয়া যায়নি। প্রকৃত খুনিদের আড়াল করতেই আইএস নাটক সাজানো হয়েছিল। হোসেনী দালানের হামলার পরও আইএসের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। চিহ্নিত গোষ্ঠী পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে ও সরকারকে চাপে ফেলতে তাদের অন্যায় ও অসাধু উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে আইএসের নাম ছড়াচ্ছে। তবে এর পেছনে যারা রয়েছে, তাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য ও অকাট্য প্রমাণ রয়েছে।
আছাদুজ্জামান বলেন, তাভেলা হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি ছিল শরীফের। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে ঘটনার দিন সকালে আরিফিন তার কাছ থেকে মোটরসাইকেলটি নেয়। খুন করার পর রাতে তা ফেরত দেওয়া হয়। দুই রাসেলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, রোববার রাতে শাখাওয়াতের বাসার গ্যারেজ থেকে হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। তারা দু’জন নেশাগ্রস্ত। বিভিন্ন মামলায় তারা কারাভোগ করেছে।

রুবেল ঠা া মাথার দুর্ধর্ষ খুনি। আর শরীফ ইয়াবা ও অস্ত্র বিক্রির সঙ্গে জড়িত। হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি উদ্ধারে অভিযান চলছে। তাভেলা হত্যাকাণ্ডের স্থল ও আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে এবং বিশ্বস্ত গুপ্তচর ও প্রযুক্তির সাহায্যে হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া তিনজনকে শনাক্ত করা হয়।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, চৌকস পুলিশ কর্মকর্তাদের এ মামলার তদন্তে নিযুক্ত করা হয়। দুটি পৃথক তদন্ত-সহায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। খুনি শনাক্তে প্রযুক্তি ও বিশ্বস্ত গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, বিদেশি নাগরিক রিটা কিৎজা পরিচালিত সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপে দাবি করা হয়েছিল, আইএস দায় স্বীকার করেছে। তবে বিশ্বে বিভিন্ন ঘটনায় কার্যক্রমের পর আইএস নিজস্ব ওয়েবসাইটগুলোতে ঘটনার দায় স্বীকার করে। এসব সাইটের লিঙ্ক বিশ্লেষণ করে কোথায়ও তাভেলা হত্যায় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনটির দায় স্বীকারের বিষয়টি পাওয়া যায়নি। রিটা কিৎজা আইএসের দায় স্বীকারের বিষয়টি কোথায় পেয়েছেন, তা জানতে তাকে ই-মেইল করা হয়েছিল। তিনি কোনো জবাব দেননি। তা ছাড়া তদন্তেও তাভেলা হত্যায় আইএস বা কোনো জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা মেলেনি।
এক প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেন, সিসিটিভির ফুটেজ ছাড়াও প্রযুক্তির সহায়তায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। অকাট্য ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়া পেশাদার বাহিনী হিসেবে পুলিশ কথা বলে না। আগে থেকে কয়েকজনকে আটক করে রাখা হয়েছে- এ ব্যাপারে এক সংবাদকর্মীর এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘এই তথ্য সঠিক নয়। পুলিশ রোববারই তাদের গ্রেফতার করেছে। প্রথম থেকেই অনেক সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতা বলে আসছেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তাভেলাকে খুন করা হয়েছে। তদন্তে এর কোনো প্রভাব পড়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, রাজনৈতিক নেতারা রাজনৈতিক বক্তব্য দেবেন- এটাই স্বাভাবিক। বিরাগ-অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে পুলিশ পেশাদার বাহিনী হিসেবে নির্মোহভাবে হত্যা মামলার তদন্ত করেছে।
তদন্তে যা উঠে আসছে: সূত্র জানায়, তাভেলা হত্যা মামলার মাঠ পর্যায়ের নির্দেশদাতা হিসেবে যে কোনো সময় এম এ মতিন গ্রেফতার হতে পারেন। বিদেশি হত্যার ঘটনায় এর বাইরে আরও বড় কোনো ‘রাঘববোয়াল’ জড়িত রয়েছে কি-না, তা তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এম এ মতিন হয়তো মাঠ পর্যায়ের সমন্বয়কারী। তাকে অন্য কেউ পুরো মিশন বাস্তবায়নে নির্দেশনা দিয়েছেন। এ নিয়ে ৩০ লাখ টাকার চুক্তি হয়। মতিনের ভাই কমিশনার আবদুল কাইয়ুম বর্তমানে লন্ডনে আছেন। এ হত্যায় তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মতিন পেশায় তৈরি পোশাক কারখানার ব্যবসায়ী। তবে কয়েক বছর আগে তিনি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন।
পরিবারের বক্তব্য: সিজার তাভেলা হত্যায় জড়িত চারজনকে রোববার গ্রেফতারের কথা পুলিশ বললেও অনেক আগেই তাদের আটক করা হয় বলে দাবি স্বজনদের। মতিনের স্ত্রী দিলরুবার দাবি, গত মঙ্গলবার রাতে এশার নামাজের পর বাসায় ফিরছিলেন তার স্বামী। বাড্ডা লিঙ্ক রোডে নিজ বাসার সামনে এলে ওত পাতা সাদা পোশাকের কয়েক যুবক তার গতিরোধ করে। তারা তাকে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলে যায়। বাড্ডা থানায় ছুটে গিয়েও কোনো লাভ হয়নি। তারা বলছেন, গ্রেফতারকৃতরা অপরাধমূলক কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন। রুবেলের মামা মাইনুদ্দিন আহমেদ তৌহিদ সমকালকে বলেন, ১২ অক্টোবর রাতে বাসায় না ফেরায় রুবেলের খোঁজ শুরু হয়। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। কোথাও খোঁজ না পেয়ে ২১ অক্টোবর বাড্ডা থানায় একটি জিডি করা হয়।

শাখাওয়াত হোসেন শরীফ মধ্য বাড্ডার ট-১১৯ নম্বর হাসিনা মঞ্জিলে থাকে। ওই বাসার নিরাপত্তাকর্মী রিপন সমকালকে বলেন, ১৫ অক্টোবর মধ্যরাতে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ১০-১২ জন বাসায় ঢোকে। তারা চারতলা বাসার চিলেকোঠা থেকে শরীফকে আটক এবং তার মোটরসাইকেল জব্দ করে নিয়ে যায়। বাসার সিসি ক্যামেরায় এ দৃশ্য ধরা পড়ে বলেও জানান রিপন।
রাসেল চৌধুরী দক্ষিণ বাড্ডার ব-২৯ নম্বর টিনশেড বাসায় থাকে। তার বোন সুবর্ণা রূপা দাবি করেন, ১০ অক্টোবর সকালে ডিবি পরিচয়ে একটি দল বাসা থেকে তার ভাইকে আটক করে। এ সময় একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনের আগে পুলিশের হেফাজতে থাকা শুটার রুবেলের কাছে তাভেলা হত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে সে সমকালকে বলে, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় সে আরিফিনের সঙ্গে গুলশানে যায়। হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে সে। শরীফ জানায়, পূর্বপরিচিত আরিফিন তার মোটরসাইকেল নিয়ে কী কাজে ব্যবহার করেছে, তা সে জানত না। তবে আরিফিন ও চাক্কি রাসেলের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গুলশান ২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়কের গভর্নর হাউসের দক্ষিণ পাশের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে ফুটপাতে সিজার তাভেলাকে (৫০) গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আইসিসিও নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রুপের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর পাঁচ দিন পর গত ৩ অক্টোবর রংপুর সদরের আলুটারী গ্রামে একই কায়দায় জাপানের নাগরিক হোশি কোনিওকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *