কিছুই বলার নেই জান্নাতির বাবার

Slider বাংলার মুখোমুখি

তিস্তাপাড়ের সবুজ গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে হেঁটে যেত ছোট্ট একটি মেয়ে। চোখে তার রাজ্যের বিস্ময়, ঠোঁটে লেগে থাকত মিষ্টি হাসি। জান্নাতি, নামের মতোই পবিত্র আর স্নিগ্ধ ছিল সে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত, কিন্তু তার স্বপ্নগুলো ছিল আকাশের মতো বিশাল। বাবার চোখে সে দেখত ভবিষ্যতের আলো, ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা।

কিন্তু বুধবার সন্ধ্যায় যখন একদল হায়েনা জান্নাতিকে টেনে নিয়ে গেল, তখন হয়তো তার ছোট্ট মনটা ভয়ে কেঁপে উঠেছিল।

নিহত জান্নাতি বেগম লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চর ভোটমারী গ্রামের ফজলুল হকের মেয়ে। বুধবার রাতে পাশের একটি ভুট্টা ক্ষেতে মুখে মাটি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাকে। এই ঘটনার পর অভিযুক্ত বেলাল হোসেন (২০) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এই ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার দিনভর লালমনিরহাট টেকনিক্যাল কলেজ গেট ও নিহত ছাত্রীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভোটমারী এসসি উচ্চ বিদ্যালয়ের গেটসহ ৬টি স্থানে মানববন্ধন করে বিচার দাবি করা হয়। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার যুবকের বাড়ি ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা।

জান্নাতির বাবা একজন কৃষক। নিজের সবটুকু ভালোবাসা আর শ্রম দিয়ে মেয়েকে আগলে রেখেছিলেন তিনি। দারিদ্র্য হয়তো তাদের নিত্যসঙ্গী ছিল, কিন্তু জান্নাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন তাদের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিত। মেয়ের চোখে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে তিনিও নতুন করে বাঁচার প্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন।

জান্নাতির সহপাঠীরা বলছে, এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড শুধু জান্নাতির জীবন কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে একটি পরিবারের স্বপ্ন, একটি গ্রামের আশা। যারা এই নৃশংসতা ঘটিয়েছে, তারা শুধু একটি নিষ্পাপ প্রাণ নয়, একটি ভবিষ্যৎকেও হত্যা করেছে।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, বুধবার সন্ধ্যায় স্কুলছাত্রী জান্নাতি বেগমকে বাড়িতে রেখে পাশে অসুস্থ মাকে (জান্নাতির নানিকে) দেখতে যান জান্নাতির মা। রাতে বাড়ি ফিরে মেয়েকে না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে তাদের বাড়ির পাশে ভুট্টাক্ষেত থেকে স্থানীয় যুবক বেলাল হোসেনসহ ৪-৫ জনকে পালিয়ে যেতে দেখে সন্দেহ হয় জান্নাতির মায়ের। পরে সেই ভুট্টা খেতে গিয়ে তার মেয়ের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়দের মাধ্যমে পুলিশে খবর দেওয়া হয়।

পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। জান্নাতির মুখ থেকে গলা পর্যন্ত মাটি ঢুকিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে ঘাতকরা। এ ঘটনায় বুধবার রাতেই বেলাল হোসেনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৪/৫ জনের বিরুদ্ধে কালীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত জান্নাতির বাবা ফজলুল হক। এ মামলায় রাতেই পুলিশ বেলাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে।

পুলিশের ধারণা, ধর্ষণ নয়, গ্রেপ্তার বেলালের ভাইয়ের সাথে জান্নাতির ভাইয়ের দ্বন্দ্বের জেরে জান্নাতিকে হত্যা করতে পারে ঘাতকরা। গ্রেপ্তার বেলালকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে বাকিদের গ্রেপ্তার ও হত্যার মূল রহস্য উদঘাটনে তদন্তে নেমেছে পুলিশ।

এদিকে তিস্তা চরাঞ্চলের স্কুলছাত্রী জান্নাতি হত্যার বিচার দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে লালমনিরহাট টেকনিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। একই দাবিতে ভোটমারী এসসি উচ্চ বিদ্যালয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন জান্নাতির সহপাঠী ও শিক্ষকরা। ভোটমারী বাজারে মানববন্ধন করেছেন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। কালীগঞ্জ থানার সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে থানা ঘেরাও করেন লালমনিরহাট টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী, জান্নাতির পরিবার আত্নীয়-স্বজন ও স্থানীয়রা।

নিহত জান্নাতির বাবা ফজলুল হক বলেন, আমার কিছু বলার নেই, যে মেয়েটি সবসময় হাসিমুখে থাকতো, এই মেয়েটিকে আজকে হারিয়েছি। তার অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তার স্বপ্ন আমি বাস্তবায়ন করতে দিতে পারলাম না। এই ব্যর্থতা সবচেয়ে বেশি আমার।

কালীগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিম মালিক বলেন, জান্নাতি হত্যা মামলায় বেলাল ও তার মাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। তবে নিহতের ভাইয়ের সঙ্গে গ্রেপ্তার যুবকের ভাইয়ের দ্বন্দ্ব রয়েছে, এমন বেশ কিছু তথ্য আমাদের কাছে মিলেছে। এই ঘটনার সঙ্গে যেই জড়িত থাক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। দ্রুত তাদের তদন্ত করে গ্রেপ্তার করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *