বাংলাদেশ নিয়ে বেইজিংয়ের ‘অতি আগ্রহ’, দিল্লির জন্য কীসের ‘ইঙ্গিত’

Slider জাতীয়

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘ধীর চলো’ নীতিতে ছিল। তবে নতুন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসছে। বেইজিংয়ের ‘অতি আগ্রহে’ সম্পর্কে গতি বাড়াচ্ছে ঢাকা। আর সেটি অন্য কোনো বন্ধু রাষ্ট্রকে শক্র না বানিয়ে সতর্কতার সঙ্গে করতে চায় বাংলাদেশ।

চলতি বছর বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি হবে। ঢাকা-বেইজিং এটিকে স্মরণীয় করতে জানুয়ারি থেকে দৃশ্যমান কিছু অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বেইজিং চায়— পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের আলোচনার মধ্য দিয়ে এটি শুরু হোক। সেই লক্ষ্যে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র আমন্ত্রণে আগামী ২০ জানুয়ারি চীন সফরে যাবেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে চীন যাবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি আগামী ২০ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি চীন সফর করবেন। সফরে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দ্বিপক্ষীয় বৈঠক বসবেন। তারা দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করবেন। আলোচনায় থাকতে পারে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ইস্যু। উপদেষ্টার সফর নিয়ে মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সভাপতিত্বে একটি আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

ঢাকার কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন দৃশ্যমান। পুরো বিশ্ব সেটি দেখেছে। স্বাভাবিকভাবে তৃতীয় পক্ষ বা বন্ধু কোনো রাষ্ট্র সেটি কাজে লাগাতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার কিন্তু রাজনৈতিক সরকার নয়। সেজন্য চীনের যত আগ্রহ থাকুক না কেন কোনো সিদ্ধান্ত বা প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে বুঝেশুনে নিতে হবে। এদিকে ভারতকে মাথায় রাখতে হবে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

এক কূটনীতিক বলেন, ঢাকার প্রতি বেইজিংয়ের আগ্রহ রয়েছে। আসলে চীনের সঙ্গে সম্পর্কে ক্ষেত্রে সরকার ‘ধীরে চলো’ নীতিতে ছিল। তবে এখন সেটা নেই। মানুষে-মানুষে যোগাযোগের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাংলাদেশে প্রভাব বাড়াতে চায় চীন। সেই লক্ষ্যে বছরজুড়ে উভয়পক্ষ কিছু প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। ঢাকা ছাড়াও অন্যান্য গুরত্বপূর্ণ শহরকে কেন্দ্র করে কিছু প্রোগ্রাম হওয়ার কথা রয়েছে।

জানা গেছে, আগামী ২১ জানুয়ারি বেইজিংয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আসন্ন চীন সফরে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। তিনি বেইজিং ছাড়াও চীনের সাংহাই সফর করবেন।

ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দেওয়া হবে। তবে চীনের দিক থেকে দেশটির প্রেসিডেন্টের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশকে যুক্ত করার জন্য সমঝোতা স্মারক সইয়ের বিষয়ে জোর দেবে বেইজিং। এ ছাড়া, বিগত সরকারের সময়ে বাংলাদেশে যে-সব প্রকল্প হাতে নিয়েও শেষ করতে পারেনি, সেগুলো শেষ করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে পাশে চাইবে বেইজিং।

বেইজিং সফর নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি যাচ্ছি। তবে কি নিয়ে আলোচনা হবে সেটি সফরের পর বলতে পারব।

গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ঢাকা-দিল্লির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি হয়। বিশেষ করে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এবং কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলার ঘটনা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিবেশ তৈরি করে।

তবে গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরের পর সাম্প্রতিক সময়ে দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্কে আস্থা বাড়ার মতো একটি উদ্যোগ দৃশ্যমান বা চোখে পড়েছে। গত ৫ জানুয়ারি ভারত আর বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড একে অপরের দেশে আটক মোট ১৮৫ জন জেলেকে নিজ দেশে ফেরত দিয়েছে। একই সঙ্গে দুই দেশ আটককৃত নৌযানগুলো হস্তান্তর করেছে। দিল্লির বিদেশ সচিবের ঢাকা সফরের পর এটিকে বড় পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কূটনীতিকরা।

স্মরণ করা যেতে পারে, সদ্য শেষ হওয়া বছরের ডিসেম্বরে ভারতীয় বিদেশসচিব ঢাকা সফরের আগ মুহূর্তে তুরস্কের একটি হাসপাতাল পরির্দশন করেন পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন। সেটি দিল্লিকে একটি কূটনৈতিক ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল।

বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কে গতি বাড়ানো দিল্লিকে ঢাকার কোনো ইঙ্গিত কিনা— জানতে চাইলে ঢাকার দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক বলেন, সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। দৃশ্যমান কিছু করার পরিকল্পনা আছে উভয়পক্ষের, এমন কিছু করা যেটা চোখে পড়বে। চীন বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক বেশি এনগেজমেন্ট চাইছে। যেহেতু ভারতের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে চায়না মনে করছে, এটাই উপযুক্ত সময় এনগেজ হওয়ার জন্য। সেজন্য তারা আরেকটু গতি বাড়াতে চাইছে। ৫০ বছর পূর্তিটাকে কাজে লাগাতে চাইছে।

এই কূটনীতিক বলেন, সরকার খুব সচেতনতার সঙ্গে সামনে এগোচ্ছে। কারণ, বুঝেশুনে ভারতকে শক্র বানাতে চায় না বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরকার ইতিবাচক। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে এখন নতুন সরকার, সেটাও মাথায় রেখে আমাদের সামনে পা ফেলতে হবে। আমরা খুব সচেতনতার সঙ্গে এগোচ্ছি।

সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র— এই তিনটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। কেননা, এই তিন বন্ধু রাষ্ট্রে বাংলাদেশের স্বার্থ নিহিত।

তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা প্রতিবেশীর (ভারত) সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক চাই, চীনের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক চাই। কারণ, ভালো সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের সঙ্গে আমাদের স্বার্থ আছে।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে চীনের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেখা গেছে, পশ্চিমা অনেক দেশ তাদের কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে আসছে। কারণ, রাজনৈতিক সরকারের সময়ে কিছু করতে গেলে বেশ কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেই সুযোগটাই হয়ত বন্ধু রাষ্ট্রগুলো কাজে লাগাতে চাইছেন। চীনের দিক থেকেও তাদের প্রকল্প কিংবা তাদের একটি উদ্যোগ জিডিআইয়ে বাংলাদেশকে যুক্ত করার চেষ্টা থাকবে বলে আমি মনে করি। আমাদের একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, চীনের আগ্রহে আমরা কতটা সাড়া দিচ্ছি সেটা কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *