গুগল ম্যাপে লেখা ‘এখানে মোবাইল চুরি হয়’, রহস্য কী?

Slider তথ্যপ্রযুক্তি


ধরুন, আপনি অচেনা কোনো স্থানে অবস্থান করছেন। সেখানকার পথঘাট সম্পর্কে তেমন জানাশোনা নেই। আশপাশে জিজ্ঞাসা করার মতোও কেউ নেই। কিংবা কোথাও গিয়ে পথ হারিয়েছেন, কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। আবার আন্দাজ করে যাত্রা শুরুও করা যাচ্ছে না, সেক্ষেত্রে গন্তব্যের চেয়ে আরও দূরে কোথাও চলে যাওয়ার শঙ্কা থাকে।

এ ছাড়া সময় অপচয় কিংবা অন্য কোনো বিপদে পড়ার সম্ভাবনাও থাকে। এমন পরিস্থিতিতে আপনার করণীয় কী, তা ভাবতে ভাবতেই পার হয় দীর্ঘক্ষণ। বিব্রতকর এ পরিস্থিতিতে পড়লে আপনাকে পথ দেখাতে পারে ‘গুগল ম্যাপ’। স্মার্টফোন হাতে নিয়ে গুগল ম্যাপ বের করতেই দেখা যাবে আপনার লোকেশন। গন্তব্যের স্থানও দেখিয়ে দেবে আপনাকে।

এমন বাস্তবতায় আপনি আপনার লোকেশন জানার চেষ্টা করলেন, গুগল ম্যাপ আপনার লোকেশনও জানিয়ে দিল। পাশাপাশি আপনাকে একটি বার্তা দিল, ‘এখানে মোবাইল চুরি হয়’। কী করবেন? এটি তো ভয়ংকর তথ্য!

আপনি আপনার লোকেশন জানার চেষ্টা করলেন, গুগল ম্যাপ আপনার লোকেশনও জানিয়ে দিল। পাশাপাশি আপনাকে একটি বার্তা দিল, ‘এখানে মোবাইল চুরি হয়’। কী করবেন? এটি তো ভয়ংকর তথ্য

খোদ রাজধানীতেই এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন অনেকে। কারওয়ান বাজার গোলচত্বর থেকে পান্থপথে যাওয়ার পথে ডানপাশের জায়গাটি পিন পয়েন্ট করে এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে গুগল ম্যাপ থেকে। সেখানে বলা হয়, ‘এখানে মোবাইল চুরি হয়’। এমন কিছু স্ক্রিনশট ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অনেক হাস্যরস করেছেন নেটিজেনরা, আবার অনেকে লেখাটি ‘সতর্কবার্তা’ হিসেবে নিয়েছেন। যদিও পরে গুগলের পক্ষ থেকে চিহ্নিত স্থান ও লেখাটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তারপরও অনেকের মনে প্রশ্ন— এটি কীভাবে গুগল ম্যাপে এলো?

জানা গেছে, গুগল ম্যাপে পয়েন্ট যুক্ত করতে ও লেভেল বাড়াতে বিভিন্ন কন্টেন্ট যুক্ত করে থাকেন লোকাল গাইডরা। এর মধ্যে স্থানের নাম, বাসা-বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের নাম, ছবি, রাস্তা— এগুলো যুক্ত করা হয়। চাইলে তা এডিটও করা যায়। কারওয়ান বাজারের ওই অংশটি চিহ্নিত করে সেখানে কেউ হয়তো এডিট করে লিখে দিয়েছেন— ‘এখানে মোবাইল চুরি হয়’।

আসলেই কি স্থানটিতে মোবাইল চুরি হয়— ঢাকা পোস্টের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর মধ্যে যতগুলো মোবাইল ছিনতাই ও চুরির স্পট রয়েছে, তার মধ্যে কারওয়ান বাজার অন্যতম। কারওয়ান বাজার মোড় ও এর আশপাশের এলাকায় প্রায় প্রতিদিন মোবাইল ছিনতাই কিংবা চুরির ঘটনার ঘটে। দিন কিংবা রাত, কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট, পান্থপথ, হাতিরঝিল অথবা বাংলামোটরগামী প্রতিটি রাস্তায় মোবাইল ছিনতাই ও চুরির অনেক অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে অফিস শেষে রাতে বাসায় ফেরার সময় অনেকেই মোবাইল ছিনতাই বা চুরির ঘটনার শিকার হয়েছেন।

কারওয়ান বাজার গোলচত্বর থেকে পান্থপথে যাওয়ার পথে ডানপাশের জায়গাটি পিন পয়েন্ট করে এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে গুগল ম্যাপ থেকে। সেখানে বলা হয়, ‘এখানে মোবাইল চুরি হয়’। এমন কিছু স্ক্রিনশট ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অনেক হাস্যরস করেছেন নেটিজেনরা, আবার অনেকে লেখাটি ‘সতর্কবার্তা’ হিসেবে নিয়েছেন। যদিও পরে গুগলের পক্ষ থেকে চিহ্নিত স্থান ও লেখাটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে

এমন একজন ভুক্তভোগী হলেন জিহাদ রহমান। পান্থপথে অবস্থিত বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের একটি কাপড়ের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। গত ৫ জুন রাতে বাসায় ফেরার পথে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল থেকে ফার্মগেট যাওয়ার পথে তার মোবাইলটি ছিনতাই হয়।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জিহাদ রহমান বলেন, আমার বাসা ফার্মগেট তেজকুনি পাড়ায়। ঘটনার দিন রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে মার্কেট থেকে বের হই। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম থাকায় হেঁটে ফার্মগেট যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এর মাঝে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পার হয়ে ফার্মগেটের রাস্তায় উঠতেই গ্রামের বাড়ি থেকে আম্মা ফোন দেন। ফোনে কথা বলতে বলতে কারওয়ান বাজার মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে যেতেই পেছন থেকে একজন আমার মোবাইল নিয়ে দৌড় দিয়ে পান্থপথের দিকে চলে যায়। আমি পেছন পেছন কিছুক্ষণ দৌড়াই, কিন্তু রাস্তায় প্রচুর গাড়ি থাকায় ঠিকভাবে সামনে এগোতে পারছিলাম না। দেখলাম একজন কিশোর আমার ফোন নিয়ে পান্থপথে জ্যামের মধ্যে হারিয়ে গেল। এরপর থানায় গিয়ে একটা জিডি করি, আজও ফোনের কোনো হদিস পাইনি।

‘শুধু আমি নই, আমার পরিচিত অনেকেই কারওয়ান বাজার সিগন্যালে এভাবে মোবাইল ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। একশ্রেণির ভবঘুরে কিশোর কারওয়ান বাজার এলাকায় ঘোরাঘুরি করে। রাত হলে তারাই ছিনতাইকারী হয়ে যায়।’
শুধু আমি নই, আমার পরিচিত অনেকেই কারওয়ান বাজার সিগন্যালে এভাবে মোবাইল ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। একশ্রেণির ভবঘুরে কিশোর কারওয়ান বাজার এলাকায় ঘোরাঘুরি করে। রাত হলে তারাই ছিনতাইকারী হয়ে যায়
ভুক্তভোগী জিহাদ রহমান

জিহাদ রহমানের মতো অনেকে কারওয়ান বাজার এবং এর আশপাশের এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করেছেন।

এমনও অভিযোগ পাওয়া গেছে, রাতে বাস কিংবা অন্য গাড়ির জানালার পাশে বসে ফোনে কথা বলার সময় কিংবা ফোন হাতে থাকা অবস্থায় অন্যমনস্ক হলেই ভবঘুরে কিছু কিশোর/যুবক তা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। বিষয়টি জানতে সরেজমিনে তদন্তে নামে ঢাকা পোস্ট।

বুধবার (৩ জুলাই) ও বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) রাতে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কারওয়ান বাজার সিগন্যাল থেকে রেলগেট ও পান্থকুঞ্জ পার্ক পর্যন্ত উঠতি বয়সী চার-পাঁচজন কিশোর ছেলের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তারা সিগন্যালে পড়া গাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। বিভিন্ন বাস, প্রাইভেটকার ও অটোরিকশার জানালায় উঁকি দিতে দেখা যায়। পুলিশ দেখলেই তারা ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত পালিয়ে যায়।
অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি আমরা মানুষকে সচেতনও করে থাকি। কেউ যদি যানজটে বাসের জানালার পাশে বসে মোবাইল ব্যবহার করেন, তখন আমরা গিয়ে সচেতন করি। কারণ, ছিনতাইয়ের অধিকাংশ ঘটনা ঘটে বাস কিংবা অন্য কোনো বাহনের জানালার পাশে মোবাইল ব্যবহারের সময়
বিট ইনচার্জ (তেজগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক) মো. সবুর

রাত ৮টার পর কারওয়ান বাজার সিগন্যালে মানুষের চাপ বাড়ে, রাস্তার দুই পাশে যানবাহনগুলো যেন স্থবির হয়ে পড়ে। এ সময় ভবঘুরে কিশোরদের তৎপরতাও বেড়ে যায়। রাত ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত তাদের সরব উপস্থিতি সবারই নজর কাড়ে।

অভিযোগ রয়েছে, কিশোর গ্রুপগুলো মূলত কারওয়ান বাজার এলাকায় মোবাইল ছিনতাই করে। যানজটে থেমে থাকা গাড়ির জানালা দিয়ে যাত্রীদের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে তারা পালিয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, প্রতি মাসে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল এলাকায় প্রায় ১৫-২০টি মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

জানা গেছে, কারওয়ান বাজার সিগন্যাল এবং এর আশপাশের এলাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) চারটি থানার অন্তর্ভুক্ত। থানাগুলো হলো- শাহবাগ, কলাবাগান, হাতিরঝিল ও তেজগাঁও। ছিনতাইকারীদের দমনে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল এলাকায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে তেজগাঁও থানা পুলিশ। কারওয়ান বাজার এলাকাকে দুটি বিটে ভাগ করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা। এর মধ্যে একটি বিটের ইনচার্জ হচ্ছেন তেজগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সবুর।

কারওয়ান বাজার এলাকায় মোবাইল ছিনতাই প্রতিরোধে ডিএমপির নেওয়া উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কারওয়ান বাজার ও সোনারগাঁও সিগন্যাল এলাকায় বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আমাদের বিশেষ টহল টিম থাকে। এ সময় আমি নিজেও উপস্থিত থাকি। প্রতিদিন আমরা ছিনতাইকারীদের আটকে অভিযান পরিচালনা করি। প্রায়ই তাদের আটক করি এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেই। তবে, প্রতিদিন যে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে, এমনটি নয়। ঘটে না, সেটিও বলা যায় না। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি ছিনতাইকারীদের প্রতিরোধ করতে।
প্রতি মাসে অত্র এলাকা থেকে আমরা ১৫-২০ জন ছিনতাইকারীকে আটক করতে সক্ষম হচ্ছি। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হচ্ছে। এ ছাড়া কারওয়ান বাজার এলাকায় আমাদের টহল জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধিতেও আমাদের কাছ চলছে
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন

বিট ইনচার্জ হিসেবে ছিনতাই প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা হয় কি না— জানতে চাইলে এসআই সবুর বলেন, ‘অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি আমরা মানুষকে সচেতনও করে থাকি। কেউ যদি যানজটে বাসের জানালার পাশে বসে মোবাইল ব্যবহার করেন, তখন আমরা গিয়ে সচেতন করি। কারণ, ছিনতাইয়ের অধিকাংশ ঘটনা ঘটে বাস কিংবা অন্য কোনো বাহনের জানালার পাশে মোবাইল ব্যবহারের সময়।’

এদিকে, গুগল ম্যাপে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল এলাকা চিহ্নিত করে ‘এখানে মোবাইল চুরি হয়’ লেখা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয় তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীনের কাছে। তিনি বিষয়টি জানেন না বলে এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন। তার মন্তব্য, কারওয়ান বাজার এলাকায় ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে।

‘প্রতি মাসে অত্র এলাকা থেকে আমরা ১৫-২০ জন ছিনতাইকারীকে আটক করতে সক্ষম হচ্ছি। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হচ্ছে। এ ছাড়া কারওয়ান বাজার এলাকায় আমাদের টহল জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।’

তবে, ছিনতাইয়ের ঘটনা থেকে কারওয়ান বাজার এলাকায় পকেটমারের ঘটনা বেশি। তা-ই ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষায় আমরা মানুষজনকে নিয়মিত সচেতন করে আসছি। কারণ, সচেতনতা ছাড়া এ ধরনের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়— বলেন মোহাম্মদ মহসীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *