কেএনএফের সাথে শান্তি আলোচনার মধ্যেই কেন ব্যাংক ডাকাতি?

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

মাত্র ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতির ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

এই ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ঘটনার সাথে কেএনএফ বা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) জড়িত। কেএনএফকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন’ হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী।

শুধু ব্যাংক ডাকাতিই নয়, সোনালি ব্যাংকের ম্যানেজারকে অপহরণ, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র লুট করেছে হামলাকারীরা।

সরকারের সাথে কেএনএফের যখন শান্তি আলোচনা চলছে ঠিক সে সময়ে এসব ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

এমন অবস্থায় কেএনএফের সাথে আগামী ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য শান্তি আলোচনা বাতিল করে দিয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি।

শান্তি আলোচনা কতদূর?
২০২২ সালে কেএনএফের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়েছিল বাংলাদেশে।

সংগঠনটি তাদের ফেসবুক পাতায় তখন দাবি করেছিল যে তারা বাংলাদেশের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়।

তাদের ভাষায়, ‘সুবিধাবঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর জন্যে স্বশাসিত বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ একটি ছোট রাজ্য’ চাইলেও তারা কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি।

কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাথান বমের নাম গণমাধ্যমে এসেছিল। তিনি ২০১২ সালে কুকি চিন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনস বা কেএনডিও নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন যা পরে কেএনএফ-এ রূপান্তরিত হয়।

কেএনএফকে নির্মূল করার জন্য বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী জোরালো অভিযান শুরু করে। সেনাবাহিনীও এই অভিযানে সম্পৃক্ত হয়।

গত বছর কেএনএফের সাথে সেনাবাহিনীর সংঘাত চলে। বিভিন্ন সময় বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য নিহত হয়। এমন প্রেক্ষাপটে কেএনএফের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত নিরসনের পথ বেছে নেয় সরকার।

গত বছরের মে মাসে কেএনএফ সরকারের কাছে কয়েকটি দাবি জানায়। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে-
– রুমা, থানচি, রোয়াংছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘স্বায়ত্তশাসিত’ অঞ্চল গঠন
– ওই এলাকায় কুকি-চিনের নেতৃত্বে পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল এবং
– ভারত ও মিয়ানমারে চলে যাওয়া কুকি-চিন জনগোষ্ঠীকে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা।

শান্তি আলোচনা ভণ্ডুল হয়ে গেছে?
গত বছরের জুলাই মাসে কেএনএফের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। দু’দফা ভার্চুয়ালি আলোচনার পর ৫ নভেম্বর প্রথমবার মুখোমুখি বৈঠক হয়। প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল রুমার মুনলাই পাড়াতে।

এরপর ৫ মার্চ বান্দরবানের রুমা উপজেলার বেথেল পাড়ায় সরকার ও কেএনএফের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় মুখোমুখি বৈঠক হয়েছে।

আগামী ২২ এপ্রিল তৃতীয় দফায় সশরীরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি বাতিল করে দিয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি।

শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির অন্যতম সদস্য ও বান্দরবানের সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম মনু বিবিসি বাংলাকে বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার কমিটির কাজ হচ্ছে কেএনএফের সাথে সরকারের সংযোগ স্থাপন করিয়ে দেয়া।

এই কমিটি কোনো দাবি পূরণ করা কিংবা প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে পারে না। বান্দরবানের স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে এই শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়।

শান্তি আলোচনা ভণ্ডুল করে দেয়ার জন্য কোনো মহলের ইন্ধন রয়েছে কি না সেটিও ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করেন মনিরুল ইসলাম।

প্রথম দুই দফা সংলাপে কেএনএফ সব ধরনের সশস্ত্র কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা ও অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত দুটি সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গ করে বিভিন্ন সময়ে সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখার অভিযোগ এনেছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি।

শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ও বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, সম্প্রতি ব্যাংক ডাকাতি এবং ত্রাস সৃষ্টির ঘটনায় কেএনএফের সাথে সংলাপ করার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আগামীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষে সংলাপ চালিয়ে সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অগ্রগতি কতটা ছিল?
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং এর সশস্ত্র উইং কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) প্রধান নাথান বম।

পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত সামরিক গোয়েন্দারা মনে করেন, নাথান বম বাংলাদেশের সীমান্তের বাইরে অবস্থান করেন। কর্মকর্তাদের ধারণা ভারতের মিজোরামে নাথান বমের অবস্থান রয়েছে।

শান্তি আলোচনা শুরুর পর থেকে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে শুরু করেছিল বলে ধারণা পাওয়া যায়। গত বছরের ৫ নভেম্বর কেএনএফের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির প্রথম দফা সরাসরি বৈঠকের সে রকম আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির ফেসবুক পেজে ক্যাপ্টেন ফ্লেমিং নাম দিয়ে একজন লিখেছেন – ‘সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নাই এবং কেএনএফ সেনাবাহিনীকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক জানাতে চাই যে, কুকি জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন কার্যক্রমে আপনাদের সহযোগিতার কথা আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তবে আমাদের জনগোষ্ঠীর সাথে সকল নাগরিক সুবিধা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আপনাদের উদারতা দেখানোর আহ্বান জানাই।’

কেএনএফের সাথে আলোচনায় সময় কিছু অগ্রগতি হয়েছিল বলে জানান মনিরুল ইসলাম মনু। এর অংশ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়।

কিন্তু ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় শান্তির চেষ্টা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যদের কেউ কেউ মনে করছেন সরকারের শিথিলতার সুযোগ নিয়ে কেএনএফ এই কাজ করে থাকতে পারে।

কেএনএফের বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাহাড়ে অন্যান্য সংগঠনের সাথে তাদের চরম বিরোধ রয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফকে উদ্দেশ করে বিভিন্ন সময় তারা নানা পোস্ট দিয়েছে। এসব পোস্টের মাধ্যমে জেএসএস এবং ইউপিডিএফকে নানা সতর্কবার্তা দিয়েছে কেএনএফ।

কেন এই ডাকাতি?
কেএনএফ এখন পর্যন্ত এই ঘটনার দায় স্বীকার করেনি। এই ঘটনার বিষয়ে কেএনএফের দিক থেকে কোনো বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ শুধু টাকার জন্য ব্যাংক ডাকাতি করেনি বলে তারা মনে করেন।

তিনি মনে করেন, এই ঘটনার মাধ্যমে কেএনএফ তাদের শক্তির পরিচয় দিতে চেয়েছে। কেএনএফ দেখাতে চেয়েছে যে নিরাপত্তা বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে জনসমক্ষে এসে ত্রাস সৃষ্টি করার ক্ষমতা তাদের রয়েছে।

নিজেদের সশস্ত্র অবস্থান জানান দিয়ে কেএনএফ আলোচনায় তাদের অবস্থান শক্ত করতে চেয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন, কেএনএফ এমন একটি ঘটনার মাধ্যমে দেশজুড়ে আলোচনায় আসতে চেয়েছে।

সেনা কর্মকর্তারা বলছেন, যেকোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে মোকাবেলার জন্য একদিকে যখন অভিযান অব্যাহত থাকে অন্যদিকে আলোচনাও চলমান থাকে। সেজন্যই কেএনএফের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

কিন্তু ঘটনার পর শিথিলতা দেখানোর সুযোগ কেএনএফ নষ্ট করেছে বলে তারা মনে করেন। তবে আলোচনার সুযোগ পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে বলে তারা মনে করেন না।

কর্মকর্তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী কেএনএফের বিরুদ্ধে তাদের জোরালো ভূমিকা অব্যাহত রাখবে।

তবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ কেএনএফের পক্ষ থেকেও এসেছে।

কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির ফেসবুক পেইজে গত ১২ মার্চ একটি পোস্ট দেয়া হয়েছিল। সেখানে অভিযোগ করা হয় যে বাংলাদেশ সেনাবহিনী চুক্তি ভঙ্গ করে বম সম্প্রদায়ের দুজনকে আটক করেছে। সেই পোস্টের মাধ্যমে কেএনএফ সতর্ক করে লিখেছিল – তার ফল খুব সুন্দরভাবে ফিডব্যাক দেয়া হবে।

সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *