‘ভোটে কখনও না হারা’ সেনাবাহিনীর রেকর্ড গুঁড়িয়ে দিতে পারবেন ইমরান?

Slider সারাবিশ্ব

পাকিস্তানে একটি বাক্য প্রায় প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে— ‘সেনাবাহিনী কখনও যুদ্ধে জেতেনি এবং নির্বাচনে হারেনি।’ কিন্তু কৌশলগত দিক থেকে এবারের নির্বাচনে এই ‘প্রবাদে’র একটি অংশে হেরে গেছে পাকিস্তানের প্রভাবশালী সামরিক বাহিনী।

পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত এক নির্বাচনের অপ্রত্যাশিত ফলাফলে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জাতীয় পরিষদের সিংহভাগ আসনে জয় পেয়েছেন।

রোববার দেশটির নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো দলই পায়নি। সেনাবাহিনীর ব্যাপক সমর্থনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নেতৃত্বাধীন দল পাকিস্তান মুসলিম লীগের (পিএমএল-এন) প্রত্যাশিত জয়ের আশায় রীতিমতো ঝোড়ো আঘাত হেনে শতাধিক আসনে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

গত বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জাতীয় পরিষদে ১০১টি আসনে জয় পেয়েছেন; যাদের মধ্যে ৯৬ জনই পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত। দেশটির তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন ৭৫টি আসন জিতেছে। আর এর মধ্য দিয়ে কৌশলগত দিক থেকে সংসদে একক বৃহত্তম দলে পরিণত হয়েছে পিএমএল-এন। আর বিলাওয়াল জারদারি ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পেয়েছে ৫৪টি আসন।

পাকিস্তানের নির্বাচনী বিশ্লেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, প্রত্যাবর্তনের রাজা খ্যাত নওয়াজ শরিফের জয় প্রায় পূর্বনির্ধারিত। কারণ ২০১৮ সালের নির্বাচনে যেমন সেনাবাহিনীর বেছে নেওয়া প্রার্থী ছিলেন ইমরান খান, এবারের নির্বাচনে তেমনি ছিলেন নওয়াজ।

স্বাধীনতা লাভের পর সাত দশকেরও বেশি সময়ের ইতিহাসে পাকিস্তান হয় সামরিক বাহিনীর শাসনে অথবা সেনা-সমর্থিত সরকারের শাসনাধীন ছিল। একভাবে বলা যায়, দেশটির সর্বময় কর্তৃত্ব সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত— যারা কখনোই ক্ষমতার বাইরে থাকে না।

২০১৮ সালে ইমরান খান ছিলেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ‘‘লাদলা’’ (নীলচোখের বালক); যার জয় ব্যাপকভাবে অনিবার্য হিসেবে প্রত্যাশা করা হয়েছিল। নির্বাচনে পিটিআই একক-বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পাকিস্তানে ইতিহাস রচনা করে। আর সেই সময় এটা নিয়ে খুব বেশি অবাক হওয়ার কারণও ছিল না।

কিন্তু ইমরানের ভাগ্যের চাকা পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে মোড় নেয়। সেনাপ্রধানের সাথে দূরত্ব তৈরি হয় তার এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন তিনি। ইমরানের উত্থানের মতো দ্রুতই পতন ঘটে; কারাগারে ঠাঁই হয় তার। গত ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেওয়া হয় তাকে। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনীর সাথে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়ানো ইমরান খানের রাজনৈতিক দল পিটিআইয়ের নিবন্ধন বাতিল এবং ঐতিহ্যবাহী ব্যাট প্রতীকও নিষিদ্ধ করা হয়।

ইমরানের শূন্যতায় সেনা-সমর্থনে পাকিস্তানের রাজনীতির মঞ্চে আবারও হাজির হন নওয়াজ শরিফ। লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে গত বছর দেশে ফেরেন তিনি। যদিও নওয়াজের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। কিন্তু আবারও ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্নে বিভোর নওয়াজ শরিফ সেনাসমর্থনে পাকিস্তানের নির্বাচনী নাট্যমঞ্চে ফেরেন। কেবল তাই নয়, নিজ দলের ক্ষমতায় থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে আজীবনের নিষেধাজ্ঞার আদেশও প্রত্যাহার করে নিতে সফল হন তিনি।

কিন্তু এখানেও ভাগ্যের চাকা বিরল এক মোড় নেয়। সাজানো-গোছানো স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফল মেলেনি তার দলের।
• ম্যাচ ফিক্সিংয়ের পরও সেনাবাহিনীর পরাজয়?

পাকিস্তানে একটি বাক্য প্রায় প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে— ‘সেনাবাহিনী কখনও যুদ্ধে জেতেনি এবং কখনও নির্বাচনে হারেনি।’ কিন্তু কৌশলগত দিক থেকে এবারের নির্বাচনে এই প্রবাদের একটি অংশে হেরেছে পাকিস্তানের প্রভাবশালী সামরিক বাহিনী। ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের বিস্ময় জাগানিয়া ফলাফল অবশ্যই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য বড় এক ধাক্কা; যাদের রাজনৈতিক অংশীদার ও প্রক্সি প্রার্থীদের বিজয় প্রায় নিশ্চিত বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলে ধরাশায়ী হয়েছেন তারা। ভোটের ফলাফলের দিকে গভীর দৃষ্টি রাখলে এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়বে।

নয়াদিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্ক-ট্যাংক প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে দুটি প্রদেশকে ‘‘ডিপ স্টেট’’ হিসেবে সামরিক বাহিনী পরিচালনা করে এবং যেখানে বিদ্রোহীদের শক্ত অবস্থান রয়েছে, সেই পাঞ্জাব এবং খাইবার পাখতুনখোয়ায় সেনাবাহিনীর আখ্যানকে প্রত্যাখ্যান করেছে জনগণ।

ওআরএফ বলেছে, ‘‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের সামরিক বাহিনীর মতো পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকেও বুঝতে হবে যে, অতীতের মতো তথ্য আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। যেসব রাষ্ট্র আর প্রতিষ্ঠান এই নতুন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে পারছে না এবং পুরোনো ফর্মুলায় চলছে, তারা বিস্ফোরণের মুখোমুখি হবেই।’’

ইমরান খানের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে তার দলের নজিরবিহীন সাফল্যে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানিদের মধ্যে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা ব্যাপক বেড়েছে; যা নির্বাচনের আগে পিটিআইয়ের এই নেতার সব প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। প্রতীকবিহীন পিটিআই, পরিচিত বড় কোনো নেতা ছাড়াই আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের ক্ষমতায় যাওয়ার পথকে কঠিন করে তুলেছে।

ওআরএফের মতে, এখন পিএমএল-এন মিত্র ও স্বতন্ত্রদের নিয়ে জোট সরকার গঠনে সক্ষম হলেও সেই সরকার টেকসই কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা টেকসই সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারবে না।

আর যদি তাই ঘটে সেক্ষেত্রে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির ম্যাচটি ‘‘ফিক্সিং’’ করার পরও খেলায় হেরে যাওয়ায় নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ‘পরাজিত’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *