হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের ১০০ দিন, শেষ কবে?

Slider সারাবিশ্ব

একশো দিন আগে ইসরায়েলে অকল্পনীয় এক ঘটনা ঘটেছিল। মাত্র ৭৫ বছর আগে ব্যাপক প্রতিকূলতা আর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া একটি রাষ্ট্র ওই দিন জেগে উঠেছিল তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসাবে চিহ্নিত এক হামলার মাধ্যমে।

শনিবার রাতে তেল আবিবে ৭ অক্টোবরের হামলায় নিহত শত শত ইসরায়েলির স্মরণে হাজার হাজার মানুষ শোক পালন করেছেন। শোক সভায় অংশ নেওয়া সবার মনে ঘুরে ফিরে আসছে হামাসের হাতে বন্দী প্রায় ১৩০ জিম্মির কথা; যারা এখনও গাজায় বন্দী। যদিও তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন আর বেঁচে নেই।

১০০ দিন আগে ভোর হওয়ার ঠিক পরে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হাজার হাজার হামাস যোদ্ধা গাজা সীমান্তের বেড়া টপকিয়ে এবং আকাশপথে ইসরায়েলের বিভিন্ন এলাকায় একযোগে আক্রমণ চালিয়েছিল। তারা কিবুৎজের বসতি, সামরিক ঘাঁটি এবং সীমান্ত শহরে হামলা চালায়। গাজা থেকে চালানো প্রায় দৈনন্দিনের রকেট হামলায় অভ্যস্ত ইসরায়েলিরা হামাসের উচ্চমাত্রার অনুপ্রবেশে ভড়কে যান।
হামাস যোদ্ধাদের হামলায় সীমান্ত লাগোয়া ইসরায়েলি ভূখণ্ডে প্রায় এক হাজার ২০০ জন নিহত হন। হামাসের তীব্র হামলায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষও একেবারে বিচলিত হয়ে যায়।

কিবুৎজের নোভা উৎসবে শত শত তরুণ সংগীতপ্রেমীর জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাওয়ার মরিয়া চেষ্টার ছবি ইসরায়েলকে নাড়িয়ে দেয়। উৎসবস্থলে ৩৬০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে হামাস। একই সঙ্গে আরও কয়েক ডজন ইসরায়েলি ও বিদেশিকে ধরে নিয়ে গাজায় জিম্মি করে রাখে তারা।

হামাসের হামলার পর ইসরায়েলি বোমা হামলায় নিহত ফিলিস্তিনি বেসামরিকের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গাজার ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী হামাসের পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ১০০ দিনের যুদ্ধে প্রায় ২৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন; যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শনিবার ইসরায়েলের তেল আবিবে বিশাল স্মরণ অনুষ্ঠানে নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা পোস্টার এবং প্রিয়জনের ছবি সম্বলিত টি-শার্ট পরেছিলেন। তাদের একজন ইয়োজি স্নেইডার। তার সাথে কথা বলেছেন বিবিসির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদদাতা ওয়ারি ডেভিস। ইয়োজি স্নেইডার বলেছেন, তার চাচাতো বোন শিরি বিবাসকে দুই ছোট সন্তান এবং স্বামীসহ অপহরণ করা হয়েছে।

ইয়োজি বলেন, সেখানে ১৩০ জন বেসামরিক নাগরিককে ওষুধ ছাড়াই আটকে রাখা হয়েছে। রেড ক্রসকে তাদের সাথে দেখা করার অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে না। তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্য স্বজনরা পাচ্ছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘‘আমার পরিবারের তিন প্রজন্ম নিখোঁজ হয়েছে। আমার পরিবারের তিন প্রজন্ম! আর বিশ্ব নীরবতা পালন করছে এবং আমাদের শান্ত থাকতে বলছে। আমি এটা আর নিতে পারছি না। আমি ক্লান্ত। একেবারে হতাশ।’’

ইসরায়েলের বেশিরভাগ নাগরিকই বলছে, ইসরায়েল এ যাবৎ পর্যন্ত যত ধরনের হুমকির মুখোমুখি হয়েছে, তার মধ্যে গত ৭ অক্টোবর ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। ইসরায়েলিরা কখনই নিজেদের এতটা দুর্বল বোধ করেনি। যদিও জিম্মিদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনে ইসরায়েলের নিরঙ্কুশ অগ্রাধিকার রয়েছে, তারপরও অনেকে গাজায় সহনশীলতা আর সহাবস্থানেরও আহ্বান জানিয়েছেন। কেউ কেউ ইসরায়েলের সরকারের যুদ্ধের লক্ষ্যের সাথে একমত পোষণ করেছেন।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ৭ অক্টোবর রাতের শেষ দিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় নজিরবিহীন বোমা হামলা শুরু করে। হামাসের সক্ষমতা আর সামরিক কাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস করার লক্ষ্যে যুদ্ধ চলছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল। তেল আবিব বলছে, এই লক্ষ্য অজর্ন না করা পর্যন্ত যুদ্ধ অবসানের কোনও সম্ভাবনা নেই।

অন্যদিকে, গাজা শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে খান ইউনিস পর্যন্ত বেশিরভাগ অঞ্চল তখন থেকে চালানো ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরায়েল বলছে, হামাস প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মতে, উত্তর গাজায় সংগঠিত শক্তি হিসেবে হামাস প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।

ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা বলছেন, গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশই বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গাজার চলমান পরিস্থিতিকে ‘‘অসহনীয়’’ বলে বর্ণনা করেছেন জাতিসংঘের দাতব্য ও ত্রাণবিষয়ক প্রধান।

গাজার বাসিন্দা ফাতেন আবু শাহাদাকে নিয়মিত কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয়। যে কারণে তিনি এবং তার পরিবার দক্ষিণ গাজায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ফাতেন ও তার পরিবারের সদস্যদের আশ্রয় হয়েছে এখন খান ইউনিসের একটি প্লাস্টিকের তাঁবুতে; যেখানে ইসরায়েলি ড্রোনের শব্দ তাদের নিত্যসঙ্গী।

ফাতেন বলেন, ‘‘গাজা ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজায় আর কোনও কিছুই অবশিষ্ট নেই। হাসপাতাল নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। আমাদের সন্তানরা স্কুলবর্ষ হারিয়েছে, গাজায় আর প্রাণ নেই।’’

গাজায় যুদ্ধবিরতি বিবেচনা করার জন্য ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে আছে ইসরায়েল। বিশেষ করে সেখানকার বেসামরিক মানুষের দুর্ভোগের মাত্রায় বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ অবসানের আহ্বান জোরাল হচ্ছে। এমনকি ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে বারবার নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দিলেও প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে বলেছে, গাজায় বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ‘‘অত্যন্ত বেশি।’’

ইসরায়েলের ‘‘নির্বিচার বোমা হামলা’’ সম্পর্কে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, গাজা যুদ্ধ ঘিরে বিশ্বজুড়ে সমর্থন হারাচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজের কলামিস্ট ও নেতানিয়াহুর কট্টর সমালোচক গিডিয়ন লেভি। বিবিসির সংবাদদাতা তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন— ১৯৪৮ সালের পর এবারের এই যুদ্ধ ইসরায়েলের দীর্ঘতম সংঘাতে রূপ নিয়েছে। শিগগিরই কি এই যুদ্ধের অবসান ঘটবে?

লেভি বলেছেন, ‘‘যতদিন আমেরিকানরা ইসরায়েলকে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান আকারেই যুদ্ধ চলবে।’’ তিনি বলেন, ‘‘এই যুদ্ধ আরও অনেক সপ্তাহ ধরে চলবে বলে আমি মনে করি না। তবে তার অর্থ এই নয় যে, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। কারণ পরের দিনটির কথা কেউ ভাবে না।’’

‘‘ইসরায়েল যদি গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার না করে, তাহলে সেখানে প্রতিরোধ হবে। আর প্রতিরোধ হলে সেখানে প্রতিশোধও নেওয়া হবে।’’ ইসরায়েলি সৈন্যরা মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় হামাসের অবস্থানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে যুদ্ধ শেষ করার উদ্দেশ্য থেকে নেতানিয়াহু অনেক দূরে রয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।

ইসরায়েল বলছে, হামাস পুরোপুরি পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হবে না। পুরো অঞ্চলজুড়ে— বিশেষ করে গাজায় ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বসবাসকারী হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিকের জন্য এই মুহূর্তে ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার দেখা যাচ্ছে।

সূত্র: বিবিসি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *