আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে ২৯৮টি আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে, এবার জোটের শরিকদের জন্য কোনো আসন রাখা হয়নি। যদিও তফসিল অনুসারে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রার্থীরা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমা দিতে পারবেন। সে হিসাবে আরো এক দিন সময় আছে জোটের প্রার্থী চূড়ান্ত করার।
কে, কোন দল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেন— সেটি কীভাবে নির্ধারণ করা হবে তা নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘দল নয়, জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় চূড়ান্ত প্রার্থীকে জোটে ভিড়াতে চায় আওয়ামী লীগ।’ দলটি একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু ঢাকা পোস্টকে বলেন, “জাতীয় নির্বাচনে আমাদের শরিকদের নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। আমরা জোটগতভাবে শরিকদের নিয়ে নির্বাচন করব। শরিকদের সঙ্গে আমাদের আসনবিন্যাস হবে।”
ক্ষমতাসীন দলের ১৪ দলের শরিকরা কোন কোন আসনে নির্বাচন করবেন, সেটি নিয়েও রাজনৈতিক মাঠে কানাঘুষা চলছে। তবে, আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড এটি নিয়ে কোনো কথা না বললেও দলের সাধারণ সম্পাদক জোট নিয়ে প্রতিনিয়ত বক্তব্য রাখছেন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোটের মধ্যে রয়েছে- রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর তরীকত ফেডারেশন এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (জেপি), গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-রেজাউর), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ ও ন্যাপ (মোজাফফর)।
দলীয় সূত্র মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে জোটের ব্যাপারে সাধারণ ভোটারদের আগ্রহ তত বাড়ছে। আগামী নির্বাচনে কোন দলের সঙ্গে কোন দলের জোট হবে, আওয়ামী লীগের মহাজোটের ব্যাপারেও জানতে চান অনেকে। আবার ক্ষমতাসীন দলের ১৪ দলের শরিকরা কোন কোন আসনে নির্বাচন করবেন, সেটি নিয়েও রাজনৈতিক মাঠে কানাঘুষা চলছে। তবে, আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড এটি নিয়ে কোনো কথা না বললেও দলের সাধারণ সম্পাদক জোট নিয়ে প্রতিনিয়ত বক্তব্য রাখছেন।
প্রার্থী দেখে জোটের হিসাব মিলানো হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও একই কথা বলেছেন। দলের সঙ্গে দরাদরি হতে পারে। প্রার্থিতা তো আমরা দেব। দল দিয়ে জোট হবে, প্রার্থী দিয়ে নয়।
নির্বাচন জোটবদ্ধভাবে হবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, “তাদের প্রার্থী কারা, সেটি আমরা আগে দেখি। আমাদের হাতে কিন্তু সময় আছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের তারিখ ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে আমরা দেখব, পর্যবেক্ষণ করব, পর্যালোচনা করব এবং সমন্বয় করব। ডেমো ক্যান্ডিডেটের বিষয়টি ১৭ তারিখের (ডিসেম্বর) মধ্যে ফাইনালাইজড হয়ে যাবে।”
এ বিষয়ে ১৪ দলের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ হয় ঢাকা পোস্টের। তারা বলেন, আমরা সংগঠনের চাহিদা অনুযায়ী আসন চেয়েছি। কিন্তু এবার এখনও তা চূড়ান্ত হয়নি। ১৪ দলের সমন্বয়ক আশ্বস্ত করেছেন। আমাদের চাহিদা অনুযায়ী হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এবার দেখছি, দলের চেয়ে প্রার্থীকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রার্থী দেখে জোটের হিসাব মিলানো হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও একই কথা বলেছেন। দলের সঙ্গে দরাদরি হতে পারে। প্রার্থিতা তো আমরা দেব। দল দিয়ে জোট হবে, প্রার্থী দিয়ে নয়।
তারা আরো বলেন, তৃণমূল বিএনপি রাজনীতির মাঠ এখনও গোছাতে পারেনি। অন্যদিকে, বিএনপি তো নির্বাচনে আসছে না। তাই জোটের মূল্যায়ন সঠিক ভাবে হচ্ছে না। বিরোধী দলগুলো মাঠে থাকলে জোটের মূল্যায়ন হয়। তবে, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। জোটপ্রধান শরিকদের নিরাশ করবেন না।
হিসাব করা হচ্ছে কাকে দিলে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারব। নিজ এলাকার জনপ্রিয়তা, মাঠের অবস্থান এবং নির্বাচনে জয়ী হওয়ার বিষয়গুলো মাথায় রেখে জোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে
অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক মঙ্গলবার ঢাকা পোস্টকে বলেন, “জোটের ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চলছে। ১৪ দলের জোট নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখানে দলের বিষয়টি হিসাব করা হচ্ছে না। হিসাব করা হচ্ছে কাকে দিলে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারব। নিজ এলাকার জনপ্রিয়তা, মাঠের অবস্থান এবং নির্বাচনে জয়ী হওয়ার বিষয়গুলো মাথায় রেখে জোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।”
“জোটের শরিক দল হিসেবে তারা গতবারের চেয়ে এবার বেশি আসন চাইতে পারেন। তবে, দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রার্থীরা নির্বাচন করবেন। আমাকেও যদি নির্দেশ দেয় যে বসে পড়ো বা সরে যাও, আমাকেও এ নির্দেশ পালন করতে হবে। এবারের নির্বাচন আমাদের কৌশলগত নির্বাচন। আরো দুদিন বাকি। ৩০ তারিখ (নভেম্বর) জমা দেওয়ার শেষ দিন। এদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে যাচ্ছে নাকি মহাজোটগতভাবে যাচ্ছে, সেজন্য ৩০ তারিখ পর্যন্ত দেখতে হবে।”
জানা গেছে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একক ও জোটবদ্ধ— দুভাবেই অংশ নেবে জানিয়ে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দিয়েছে। গত ১৮ নভেম্বর দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, “আমরা নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছি। সেখানে বলেছি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একক ও জোটবদ্ধ— দুভাবেই নির্বাচন করবে। কোন আসনে জোটবদ্ধ, আর কোন আসনে এককভাবে দলীয় প্রার্থী দেয়া হবে, সেটি মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর জানানো হবে।”
আমরা জোটের সঙ্গে নির্বাচনে যাচ্ছি। এখনও অনেক সময় আছে। আমাদের একটি সিট রয়েছে, সেটি ১৬ তারিখ পর্যন্ত
জানতে চাইলে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট করার বিষয়ে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে যে চিঠিটি এসেছে সেটি দিয়েছেন দলের পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু যে চিঠি দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, জাতীয় পার্টির মনোনয়ন দেবেন চেয়ারম্যান জি এম কাদের। জোটবদ্ধ নির্বাচনের বিষয়ে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই তাতে।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট এবং মহাজোটের বিকল্প ধারা ও জাতীয় পার্টিকে মোট ৩১টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। জাতীয় পার্টি রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরসহ ২৩ জন, রাশেদ খান মেননসহ ওয়ার্কার্স পার্টির তিনজন, হাসানুল হক ইনুসহ জাসদের তিনজন, মাহি বি. চৌধুরীসহ বিকল্পধারার দুজন, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এবং জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সংসদ সদস্য হন।
জানতে চাইলে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, “আমরা জোটের সঙ্গে নির্বাচনে যাচ্ছি। এখনও অনেক সময় আছে। আমাদের একটি সিট রয়েছে, সেটি ১৬ তারিখ পর্যন্ত।”
এদিকে, গত ২৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮টিতে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। মহাজোট ও ১৪ দলীয় জোটের আসনেও দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। রওশন এরশাদের ময়মনসিংহ- ৪ আসনে আওয়ামী লীগ মহিবুর রহমানকে, জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের লালমনিরহাট- ৩ আসনে মতিয়ার রহমানকে, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে নাসিরুল ইসলামকে, জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদের চট্টগ্রাম- ৫ আসনে আবদুস সালামকে, কাজী ফিরোজ রশীদের ঢাকা- ৬ আসনে সাঈদ খোকনকে, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের নির্বাচনী এলাকা ঢাকা- ৮ আসনে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে, ফজলে হোসেন বাদশার রাজশাহী- ২ আসনে মোহাম্মদ আলীকে, বিকল্পধারার মাহি বি. চৌধুরীর মুন্সীগঞ্জ- ১ আসনে মহিউদ্দিন আহমেদকে, আবদুল মান্নানের লক্ষ্মীপুর- ৪ আসনে ফরিদুন্নাহারকে, তরীকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর চট্টগ্রাম- ২ আসনে খাদিজাতুল আনোয়ারকে এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পিরোজপুর- ২ আসনে কানাই লাল বিশ্বাসকে মনোনয়ন দিয়েছে দলটি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “জোটভুক্ত দলগুলোর সঙ্গে এখনো সমন্বয় না হওয়ায় প্রায় সব আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। সংসদীয় ২৯৮টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণা করলেও জোটভুক্ত দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার পর আসন সমন্বয় করা হবে। আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে নির্বাচন করবে।”
কুষ্টিয়া- ২ ও নারায়ণগঞ্জ- ৫ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ঘোষণা করেনি আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, পরবর্তী সময়ে আসন দুটির মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হবে।