কঠোর নজরদারির মধ্যে গণতন্ত্র

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


ইকতেদার আহমেদ :

সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যেকোনো কিছু পরিচালিত হওয়াকে বলা হয় গণতন্ত্র। পৃথিবীতে আজ যেসব রাষ্ট্র উন্নত, সভ্য ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসেবে খ্যাত এর প্রতিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচিত দল একটি নির্ধারিত মেয়াদে সরকার পরিচালনা করে থাকে।

১৯৪৭ সালে ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হলেও ২৩ বছরের মাথায় দেখা গেল, জাতিসত্তার ভিত্তিতে পাকিস্তান বিভাজিত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোতে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা পরিচালনার অধিকার অর্জন করে। তবে পাকিস্তানের তখনকার সামরিক সরকার আওয়ামী লীগকে শুধু সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি; বরং এ দেশের মানুষের ওপর একটি সশস্ত্র যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়।

বাংলাদেশের সংবিধান অবলোকনে প্রতীয়মান হয়; এর প্রস্তাবনায় যে চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে তা হলো- গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।

বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী এ দেশের জনমানুষের প্রত্যাশা ছিল এখানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছর অতিক্রান্তের পর দেশবাসী স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন পরবর্তী এ দেশের সাধারণ জনমানুষের মনে প্রশ্নের উদয় হয় যে, গণতন্ত্র ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিন আন্দোলন, সংগ্রাম ও অপরিসীম ত্যাগ করেছে সে গণতন্ত্র ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন আমরা কি পেয়েছি? আর না পেয়ে থাকলে তার থেকে আমরা কত দূরে?

ব্রিটিশরা ছিল ঔপনিবেশিক শাসক। তাদের শাসনামলে তৎকালীন বৃহত্তর বাংলায় ও আসামে ভারতবর্ষ বিভাজনের প্রাক্কালে আইন সভার দু’টি নির্বাচন এবং ইউনিয়ন বোর্ডের বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সব নির্বাচনের প্রতিটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীরা প্রচার চালানোয় কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হননি। ভোটাররা নির্বিঘেœ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। নির্বাচন-পরবর্তী প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ-পরবর্তী আমরা পাকিস্তানের সাথে ২৩ বছর ছিলাম। পাকিস্তান শাসনামলে আইয়ুব খান প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচন ব্যতীত অপর যেসব জাতীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা যেমন নির্বিঘেœ প্রচার চালাতে পেরেছিলেন; অন্যদিকে ভোটাররা ভোট প্রদানে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন এমন অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। এ সব নির্বাচনে দেখা গেছে ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের অন্যথা হয়নি।

বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর প্রথম সংসদ নির্বাচনটি ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন ছিল। ওই নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের জন্য উন্মুক্ত জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৩টিতে বিজয়ী হয়। সে সময় জনমতের যে অবস্থান ছিল তাতে আওয়ামী লীগের জন্য দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সহজ ছিল। কিন্তু সে সময়কার প্রধান বিরোধী দল জাসদের (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) অন্তত ৫০টি আসন নিশ্চিত বিজয় অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে নস্যাৎ করাকে এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রের পরাজয় হিসেবে দেখেছে। সে নির্বাচনের সময় মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় এ দু’টি দলের সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের সামগ্রিক ভোট জাসদের পক্ষে পড়েছিল। সে নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলনে প্রকৃত ফল প্রকাশিত না হলেও জাসদের বিপুল ভোটপ্রাপ্তির পেছনে মুসলিম লীগ ও জামায়াতের সমর্থন একটি অন্যতম কারণ ছিল।

তৃতীয় সংসদ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হওয়ার দুই বছরের মাথায় আওয়ামী লীগ একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশালের প্রবর্তন করে। সে সময়কার জনমত এরূপ সরকার প্রবর্তনের বিপক্ষে থাকলেও আওয়ামী লীগ নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর ভর করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ইতি টানে। জনমতের অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় এরূপ একদলীয় শাসনব্যবস্থা যে আওয়ামী লীগের জন্য শুভ হয়নি তা প্রত্যক্ষ করতে দেশবাসীকে খুব বেশি দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়নি।

শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাথে তার নিজ দলের একান্ত বিশ্বস্ত কিছু নেতা জড়িত ছিল। কিন্তু হত্যাকাণ্ড সংগঠনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘুণাক্ষরেও কারো জানার অবকাশ ছিল না যে, তার একান্ত বিশ্বস্তরা তার এবং তার পরিবারের প্রতি কত নির্মম ও নির্দয় হতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা-পরবর্তী তার একান্ত বিশ্বস্ত সহযোগী যারা ক্ষমতা দখল করেছিল ক্ষমতার মসনদে তাদের অবস্থান ক্ষণস্থায়ী ছিল। সে সময় সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশ যখন অনেকটা অনিশ্চয়তার পথে তখন বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত পরবর্তী রাষ্ট্রক্ষমতায় জিয়াউর রহমান আসীন হন। জিয়াউর রহমান সেনাকর্মকর্তা ও সামরিক শাসক হলেও তিনি এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ। তা ছাড়া বাকশাল প্রতিষ্ঠার সময় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে চারটি পত্রিকা রেখে অপর সব পত্রিকা যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তিনি তার অবসান ঘটান। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তাকে ঘিরে একটি হ্যাঁ-না ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই হ্যাঁ-না ভোটে বেলা ১১টার সময় দেখা গেছে, অধিকাংশ কেন্দ্রে ৯০-৯৫ শতাংশ ভোটারের ভাটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ কাজ পরিসমাপ্ত। ওই হ্যাঁ-না ভোটে এত বেশি ভোটপ্রাপ্তি না দেখিয়ে স্বাভাবিকভাবে ভোট গ্রহণ করা হলেও তার পক্ষে হ্যাঁ ভোটের পাল্লা ভারী হতো। অতঃপর তার শাসনামলে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তৎপরবর্তী যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেটিতে তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সে সময়কার জনমতের প্রতিফলনে উভয় নির্বাচনে তার ও তার দলের বিজয়ের বিরূপ কিছু প্রত্যাশিত ছিল না। তবে উভয় বিজয়ের ক্ষেত্রে তৎকালীন মূল বিরোধী দলের সাথে যে ব্যবধান সেটিও যে অপ্রত্যাশিত সে প্রশ্নে বিতর্কের অবকাশ ক্ষীণ।

কিছুসংখ্যক বিদ্রোহী সেনাকর্মকর্তার হাতে জিয়াউর রহমানের আকস্মিক মৃত্যু হলে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কর্মরত উপরাষ্ট্রপতি সে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হলে সংবিধান সংশোধনের আবশ্যকতা দেখা দেয়। সে সংসদে সংবিধান সংশোধনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বিএনপি সে বাধা অতিক্রমে সমর্থ হয়। সে নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যুর কারণে বিপুল সংখ্যক সহানুভূতি ভোট বিএনপির পক্ষে গেলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সাথে যে ব্যবধানে বিচারপতি সাত্তার জয়ী হয়েছিলেন তা কোনোভাবে তখনকার জনমতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।

সামরিক শাসক এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে বলপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করে দেশে পুনঃসামরিক শাসন প্রবর্তন করেন। এরশাদ ক্ষমতাসীন থাকাকালীন তার প্রতি দেশবাসীর আস্থা আছে কি নেই সে প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠিত হলে তাতে আগেকার অনুষ্ঠিত গণভোটের পুনরাবৃত্তি পরিলক্ষিত হয়। এরশাদ প্রায় ৯ বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন। তার শাসনামলে রাষ্ট্রপতি পদের একটি এবং সংসদের দু’টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উপরোক্ত তিনটি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপি করে কূটকৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে তার ও দলের বিজয় নিশ্চিত করা হয়। উপরোক্ত দু’টি সংসদের কোনোটি মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি।

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদের বিদায় ঘটলে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে অপ্রত্যাশিতভাবে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং জামায়াতের সমর্থন নিয়ে দলটি সরকার গঠন করে। এ নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে ভোটারদের আগ্রহ সৃষ্টির পেছনে যে কারণ তা হলো- ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আকস্মিক আন্দোলন থেকে বিচ্যুত হয়ে অনেকটা বিএনপিকে বিপাকে ফেলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ দেশবাসী ভালোভাবে নেয়নি।

পঞ্চম সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলেও সে সংসদ বহাল থাকাকালীন আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে সম্মিলিতভাবে সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে ক্ষমতাসীন দলকে সংসদ ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হয়। আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি সম্মিলিতভাবে সে নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করলেও সেভাবে সফল হতে পারেনি। নির্বাচনটি যে অস্বচ্ছ, ত্রুটিপূর্ণ ও ভোটারবিহীন ছিল সে প্রশ্নে কোনো বিতর্ক নেই। যা হোক, বিএনপি নেতৃত্ব অনেকটা মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে সে সংসদে একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবলিত বিল পাস করে সংসদ ভেঙে দিলে ওই সরকারের অধীন অংশগ্রহণমূলকভাবে ষষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

ষষ্ঠ ও সপ্তম এ দু’টি সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমটিতে আওয়ামী লীগ এবং দ্বিতীয়টিতে বিএনপি বিজয়ী হয়। এ দু’টি নির্বাচনের ফল এ দেশের সাধারণ জনমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলেও প্রথমটির ফল বিএনপির কাছে এবং দ্বিতীয়টির আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য তো হয়নি; বরং উভয় দলের পক্ষ থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠে। এ দু’টি নির্বাচনের মতো কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনটিও বিজিত আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি এবং দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। যদিও এ দেশের সাধারণ জনমানুষের কাছে সে সূক্ষ্ম কারচুপি কখনো স্পষ্ট ছিল না।

সপ্তম সংসদের মেয়াদান্তে অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে প্রথমত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল সেটি এ সরকার গঠন-সংক্রান্ত সব বিকল্প নিঃশেষিত না করে রাষ্ট্রপতির অধীন গঠিত হয়েছিল। সে সরকার সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিস্থাপিত হলে সেটি প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে ছবিসহ ভোটার আইডি কার্ড ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটিয়ে নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। এ নির্বাচনে তখনকার জনমতের যে অবস্থান ছিল তাতে স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতো কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত এরূপ একটি নির্বাচনে যে বিপুলসংখ্যক ভোটার উপস্থিত মর্মে দেখানো হয়েছে তা অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তা ছাড়া নির্বাচনটি অনুষ্ঠান-পরবর্তী স্বল্পতম সময়ের মধ্যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দেখা গেছে, ভোটার উপস্থিতির হার সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হারের তুলনায় অর্ধেক বা অর্ধেকের কাছাকাছি।

নবম সংসদ বহাল থাকাকালীন আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসান ঘটায়। এরপর সংসদ বহাল রেখে যে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে নির্বাচনটিতে বিএনপি জোট অংশগ্রহণ হতে সরে দাঁড়ায়। সে নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫(২) এর সাথে সাংঘর্ষিক।

একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান পূর্ববর্তী দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে আশ্বস্ত করা হয় যে, সমসুযোগ সংবলিত মাঠে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু দেশবাসীসহ বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে নজিরবিহীনভাবে আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণের পূর্ববর্তী রাতে প্রশাসন, পুলিশ ও দলীয় নেতাকর্মীদের সহায়তায় ব্যালটবাক্স পূর্ণ করে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের বিজয় নিশ্চিত করা হয়। একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনটিও পূর্বসূরি নির্বাচন কমিশনের মতো ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পর এ দেশে দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত গণভোট, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনের ফল ক্ষমতাসীনদের পক্ষে গেছে। অপর দিকে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এর প্রতিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় ঘটেছে। দলীয় ও নির্দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনের যে চিত্র তা হতে ধারণা পাওয়া যায়, এ দেশে যেকোনো নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে দলীয় সরকার অন্তরায়। নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে আমাদের দেশে কখনো স্থানীয় সরকারসমূহের নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হতো না। স্থানীয় সরকারসমূহের নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা প্রবর্তন পরবর্তী দেখা গেছে দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত গণভোট, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচন যে মাত্রায় কলুষিত হয় স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সে কলুষতার মাত্রা আরো অধিক। আমাদের দেশে নির্দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহের বিষয়ে বিজিত দল কর্তৃক অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও তুলনামূলক বিচারে সে নির্বাচনগুলো যে দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনের চেয়ে অধিক স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য ছিল এ বিষয়ে দেশবাসীর মধ্যে দ্বিমত নেই।

যেকোনো নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ আখ্যায়িত করতে হলে যে বিষয়গুলো অবলোকন অত্যাবশ্যক তা হলো- মনোনয়নপত্র দাখিলের ক্ষেত্রে এবং নির্বাচনের প্রচার চালাতে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা দল কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছে কি না; ভোটারদের ওপর ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়ে কোনো চাপ বা বল প্রয়োগ করা হয়েছে কি না; ভোট অনুষ্ঠানের দিন ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছে কি না এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন কি না। আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীন যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এর প্রতিটিতে উপরোক্ত বিষয়গুলো যে সঠিকভাবে প্রতিপালিত হয়নি সে বিষয়ে দেশবাসী সম্যক অবহিত।

একটি দেশে সব শ্রেণিপেশার মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে ব্যর্থ হলে এবং সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচনকে কখনো গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যায় না। আর ভোটাধিকার ব্যক্তির ক্ষেত্রে আর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের ক্ষেত্রে যখন বাধাগ্রস্ত হয় তখন গণতন্ত্র যে কঠোর নজরদারির মধ্যে পড়ে এর নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা থেকে বিচ্যুত তা-কি অস্বীকার করা যায়?

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *