তালা ঝোলানোর এক মাস : সুনসান নীরবতা বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে

Slider রাজনীতি

আজ ২৮ নভেম্বর। গেল মাস অক্টোবরের এই তারিখে রাত ১০টার পর থেকে তালা ঝুলানো রয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ ফটকের সামনে। এক মাস হয়ে গেল। মানবশূন্য অফিসটি। যেখানে সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত চলত নেতাকর্মীদের আনাগোনা, স্লোগান। এক মাস ধরে সেখানে বিরাজ করছে সুনসান নিরবতা। নেই কোনো কোলাহল। আসে না কোনো নেতা, নেই কোনো বহর। প্রবেশ মুখের চিত্র দেখলে অনুমান করা যায়, ভেতরের রুমগুলোতে ধুলার হয়তো আবরণ পড়েছে। কয়েক গজ দূরে সামনের সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। অনেকটাই ‘একশন’ মুডে তারা।

সড়কের ফুটপাতের এক পাশে দড়ির বেড়া ও অপর পাশে লোহার বেড়া। এতে পথচারীদের যাতায়াতে প্রথমে অনেক বিধিনিষেধ থাকলেও এখন তা তেমনটা নেই, জনসাধারণকে বেশ কয়েক দিন চলাচলে কঠিন অবস্থা হলে এখন চলাচল বেড়েছে। কার্যালয়ের সামনে আছে গণমাধ্যমকর্মী-উৎসুক মানুষেরা। হয়তো কেউ আসেন ভালোবেসে, একনজর দেখার জন্য। কেউ কাছে গিয়ে দেখছেন ভেতরের কী অবস্থা, তুলছেন ছবিও। আবার কেউ ভয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছেন।

দেখতে আসা একজনের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, ২৮ অক্টোবরের পর প্রথমে কাউকে তো এলাকায় আসতে দিতো না পুলিশ। এখন একটু সুযোগ দেয়। পুলিশ কিছু বলে না। তাই দেখতে আসি, কেমন আছে, কী খবর। বিএনপি কোনো কর্মী কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কেউ ভালো নেই। আর কোনো কথা বলেননি তিনি।

অপরিদকে, গুলশান কার্যালয়ে সামনে নেই পুলিশ। মূল ফটকেও নেই তালা। তবে ভেতরে থেকে তালাবদ্ধ। গুলশানে পুলিশ না থাকলেও আসেনি কোনো নেতাকর্মী। গতকাল সোমবার সকালে নয়াপল্টন ও দুপুরে গুলশানে গিয়ে দেখা এমন চিত্র।

দুই কার্যালয়ের এই ভুতুড়ে অবস্থার সূত্রপাত ঘটে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে সংঘাতকে কেন্দ্র করে। মহাসমাবেশের দিন কাকরাইল মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে সংঘাত হয় বিএনপির নেতাকর্মীদের। এর ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। সংঘর্ষ চললেও মঞ্চ থেকে হরতাল ঘোষণা দিয়ে স্থল ত্যাগ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে দফায় দফায় সংঘর্ষ। সংঘর্ষে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও বিএনপির অনেক নেতাকর্মী আহত হন। নেতাকর্মীদের একের পর এক ছুঁড়ে মারে ইট-পাটকেল আর টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড একটা ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয় নয়া পল্টন এলাকায়। এরপর থেকেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়ক নিয়ন্ত্রণে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেদিন রাতেও বিএনপি কার্যালয়ে একাধিক নেতাকর্মী ও নিরাপত্তা কর্মী ছিলেন। তবে রাত ১০টায় তালা লাগানো হয় বলে জানা গেছে। ২৯ অক্টোরর সকাল থেকে কার্যালয়ের সামনের অংশে ‘ক্রাইম সিন’ লেখা হলুদ টেপ দিয়ে ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দু’দিন ধরে আলামত সংগ্রহ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দু’দিন পর দেয়া হয় কাঁটাতারের বেড়া। তফসিল ঘোষণার পরদিন তাও সরিয়ে নেয়া হয়। অবরোধ সর্মথনে গত ১৫ নভেম্বর কার্যালয়ে সামনে অবস্থান নিলে জাতীয়বাদী জনতা দলের তিনজনকে গ্রেফতার করে পল্টন থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।

এদিকে সংঘাতকে কেন্দ্র করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতাদের আটক করে পুলিশি। প্রায় সব নেতাকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষ কারাগারে পাঠানো হয়েছে তাদেরকে।

মহাসমাবেশ পণ্ড, শীর্ষ নেতাদের আটকের প্রতিবাদসহ একদফা দাবিতে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে বিএনপি। এক মাসে দলের ১৭ জন নেতাকর্মীর প্রাণহানি হয়েছে বলে দাবি করেছে দলটি। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, দলটির নেতাকর্মীরা বাসা বাড়িতে থাকতে পারছে না। ব্যাবসায়িকপ্রতিষ্ঠানসহ অনেক জায়গা হামলা, ভাঙচুর করে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। অভিযোগ করা হয়েছে, বাড়িতে বিএনপির নেতাকে না পেলে তার বৃদ্ধা বাবা, ভাই, ছেলেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সাথে নানা হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে।

দুপুরে গুলশানে গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়ে সামনে নেই পুলিশের কোনো উপস্থিতি। ভেতর থেকে তালাবদ্ধ করে দাড়িয়ে আছে তিনজন নিরাপত্তাকর্মীরা। পড়ে আছে বেশ কয়েকটি গাড়ি।

কার্যালয়ে কেউ আসছেন কিনা জানতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মী জুবায়ের জানান, ২৮ অক্টোবর পর কোনো নেতাকর্মী কার্যালয়ে আসেননি। নেতাকর্মী না আসায় ২৪ ঘণ্টাই গেট তালাবদ্ধ রাখি।

গুলশান কার্যালয়ের পাশেই সব সময় ঝালমুড়ি বিক্রি করেন তবারক। তিনি বলেন, নয়াপল্টনের হামলার ঘটনার পর দুই-তিন গুলশান অফিসের সামনে পুলিশ ছিল। এরপর থেকে সবকিছু স্বাভাবিক। কিন্তু কার্যালয়ে আসেনিও কোনো সিনিয়র নেতা। গত এক মাস ধরে বেচাবিক্রি নেই বললেই চলে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক বলেন, কার্যালয়ে বিএনপির কেউ আসবে কী করে, এলেই তো গ্রেফতার করবে পুলিশ।

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, সারাদেশ বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতার এড়াতে ঘরবাড়ি ছাড়া প্রত্যেক নেতাকর্মী। বাসায় নেতাকর্মীদের না পেয়ে পরিবারের সদস্য, স্বজনদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। নয়াপল্টনে ২৪ ঘণ্টাই পুলিশ অবস্থান করছে।

এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (প্রধান ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের সহিংসতার ঘটনায় বিএনপির এজাহারভুক্ত আসামিদের আদালতে হাজির হতে হবে। আর না হয় আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরবে।’

বিএনপিই তাদের অফিসে তালা ঝুলিয়েছে, এমনটি জানিয়েছে পুলিশ।

ডিএমপি পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নয়াপল্টনে ২৮ অক্টোবরের সংঘাতের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপি অফিসের সামনে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। পুলিশ তাদের অফিসে তালা দেয়নি। তারা তাদের অফিসে গেলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ কাজ করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *