মালিকদের ‘শক্ত অবস্থান‘ তৈরি পোশাক খাতকে কোন দিকে নেবে?

Slider অর্থ ও বাণিজ্য


বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণের পরেও আন্দোলন চলমান থাকায় মালিকপক্ষ ‘শক্ত অবস্থান‘ নেয়ার কথা জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাতে পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বা বিজিএমইএ এক বৈঠকে নতুন শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ রাখা, প্রয়োজনে কারখানা বন্ধ এবং ভাঙচুর-মারামারির ঘটনা ঘটলে থানায় মামলা করাসহ একাধিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘যেহেতু শ্রমিকরা ফ্যাক্টরিতে এসে কার্ড পাঞ্চ করে চলে যাচ্ছে অথবা বসে থাকছে, কাজ করছে না, সেজন্য আমরা ১৩ এর ১ ধারায় কিছু ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।’

বাংলাদেশ শ্রম আইনের এই ধারায় বলা আছে, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা বা বিভাগে বে-আইনি ধর্মঘটের কারণে মালিক উক্ত শাখা বা প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন, এবং এরূপ বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকগণ কোন মজুরী পাইবেন না।’

তবে এমন পরিস্থিতিতে মালিকদের এ সিদ্ধান্ত শ্রমিকদের সাথে তাদের আরো দূরত্ব তৈরি করবে বলে মনে করছেন শ্রমিক নেতারা।

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বিবিসিকে বলেন, ‘দিছে তো অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ করে, এভাবে তো ফ্যাক্টরি চালানো যাবে না।’

এছাড়া মামলা করা ও ভাঙচুর-মারামারির ভিডিও দেখে বিজিএমইএ আইনি ব্যবস্থা নেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা তো মামলা করতেছে, অনেক অ্যারেস্ট হইছে। এখন যদি ভিডিও দেখে মামলা করে তাহলে নিরীহ শ্রমিকরা যেন এর মধ্যে না পড়ে। সবাই বলতেছে এখানে রাজনীতি আছে, তো সেটা খুঁজে বের করুক।’

বিজিএমইএ‘র বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির পরিচালক ও ব্যবসায়ী ইনামুল হক খান। তিনি মালিকপক্ষের অবস্থান আরো ব্যাখ্যা করেন বিবিসির কাছে।

তিনি বলেন, ‘এটা আশুলিয়ার একটা জোনের সিদ্ধান্ত, বাইরে যদি অন্যরা ফ্যাক্টরি চালাতে পারে, চালাবে। কোনো সমস্যা নেই। আমরা দেখলাম সব জায়গায় নরমাল, শুধু আশুলিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তাই সেখানে আমরা বন্ধ রেখেছি, বাকি সব জায়গায় কিন্তু ফ্যাক্টরি চলছে।

তবে ইনামুল হক খান দাবি করেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছে।

‘আমরা কথা বলছি শ্রমিকদের সাথে। যে বেতন বেড়েছে তাতে তারা খুশি। কিন্তু কিছু সংগঠন ইস্যু তৈরি করছে।’

অনেকটা একই কথা বলছেন সিদ্দিকুর রহমানও। তিনি বলেন, শ্রমিকরা নতুন মজুরি মেনে নিলেও ‘বহিরাগতরা ইন্ধন‘ দিচ্ছে।

‘আমাদের সাধারণ শ্রমিদের অভিযোগ নেই। কিন্তু যারা বহিরাগত, ভাঙচুর করবে, অন্যায় করবে, তাদের তো আইনের আওতায় দিতেই হবে।’

শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা অবশ্য আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি তুহিন চৌধুরী বলেন, অঞ্চল-ভিত্তিক করে মালিকরা শ্রমিকদের সাথে আলোচনায় বসতে পারে।

তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘কিন্তু মালিকরা অনড়, তারা তো বসবে না। আমাদের সাথে বসার দরকার নেই। যে প্রতিষ্ঠানে সমস্যা সেই প্রতিষ্ঠানের সংগঠন কাজ করুক।’

সিদ্দিকুর রহমান অবশ্য দাবি, শ্রমিকদের সাথে আলোচনা হয়েছে এবং তারা মজুরি মেনেও নিয়েছেন। শুধু দুই-একটা সংগঠন এখনো মানছে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

মজুরি নিয়ে কী হচ্ছে?
সর্বশেষ ২০১৮ সালে পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ঠিক করা হয়েছিল আট হাজার টাকা।

কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে চলতি বছরের শুরু থেকেই বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছিলেন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা।

এই দাবির প্রেক্ষিতে নতুন মজুরি কাঠোমো নির্ধারণের জন্য গত এপ্রিলে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার।

গত অক্টোবরে বোর্ডের চতুর্থ সভায় ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করে প্রস্তাব দেন শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা।

অন্যদিকে, কারখানা মালিকদের পক্ষ থেকে ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরি নির্ধারণের প্রস্তাব আসে।

মালিকপক্ষের এই মজুরি প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়ে গত ২৩ অক্টোবর গাজীপুরের কয়েকটি কারখানায় আন্দোলন শুরু করেন শ্রমিকরা। পরে এটি মিরপুর, আশুলিয়া, সাভারসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।

পুলিশের সাথেও সংঘর্ষ হয় শ্রমিকদের। সবমিলে এই বিক্ষোভে তিন জনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়।

মালিকপক্ষের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে গত ৭ নভেম্বর মূল মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ১২ হাজার টাকা সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করে বাংলাদেশ সরকার।

মজুরি বৃদ্ধির এই ঘোষণাকে শ্রমিকদের একটা পক্ষ মেনে নিলেও আরেকটি পক্ষ তা মেনে নেয়নি। বরং বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে তারা।

এমন পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএ বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩ এর ১ ধারা প্রয়োগের ঘোষণা দেয়।

শ্রমিক-মালিক দূরত্ব বাড়বে?
শ্রমিকপক্ষ মনে করছে বিজেএমইএর এই সিদ্ধান্ত সংকট আরো বাড়াবে। তবে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম তা মনে করেন না।

‘আমার কাছে মনে হয় বিজিএমইএর সিদ্ধান্ত কিছুটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে। আরেকটা কৌশলগত, একটা চাপ রাখা যাতে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়। আমার মনে হয় না এতে দুই পক্ষের দূরত্ব বাড়বে। বরং আলাপ-আলোচনায় তারা যেটা বুঝতে চান, শ্রমিকদের দাবি আসলে কত?’

তিনি বলেন, বাংলাদেশে সবসময় মজুরি নিয়ে শ্রমিক নেতা ও শ্রমিকরা আন্দোলন করে এসেছেন। নিজেদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরা, চাপ দেয়া এগুলো স্বাভাবিক সংস্কৃতি।

তিনিও দুই পক্ষের আলোচনার উপর জোর দিয়েছেন।

মোয়াজ্জেম বলেন, ‘এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ব্লেম না করে সমাধানের দিকে যাওয়া প্রয়োজন। মাঝামাঝি জায়গায় একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।’

শ্রমিক নেতা নাজমা আক্তারও বলেন আলোচনার কথা। ‘আমাদের দাবি আলোচনার মাধ্যমে মজুরি পুনর্বিবেচনা করুক, শ্রমিকদের সাথে কথা বলুক।’

কিন্তু বিজেএমইএ নেতারা বলছেন, ইতোমধ্যে যে মজুরি ঠিক করা হয়েছে, সেটা দিতে গিয়েই মালিকরা হিমশিম খাবে।

বিজেএমইএ পরিচালক ইনামুল হক বলেন, ‘আমাদের বায়াররা কিন্তু বাড়তি মূল্য দিচ্ছে না, আমার ১৫টা বায়ারের মাত্র একজন বলেছে দেবে বা কিছুটা বাড়াবে, কিন্তু আমরা কিভাবে দেব জানি না।’

তিনি যোগ করেন, ‘স্বীকার করছি বেতন বাড়ানো দরকার ছিল, ৫৬ ভাগ বাড়ালাম। কিন্তু এর বেশি বাড়ানো সম্ভব না। ওই সক্ষমতা নেই আমাদের।’

তবে সব পক্ষই বলছে পোশাক খাতের এ চলমান সঙ্কট দ্রুতই কেটে যাবে। কারণ মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষকেই এই আন্দোলনের ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘এটা আর লম্বা হবার সুযোগ কম, আগেও দেখা গেছে এরকম পরিস্থিতি বেশি লম্বা হয় না। কারণ উভয় পক্ষ বোঝে লাভ না হোক, ক্ষতি উভয়ের বেশি হয়, সেটা তারা বুঝে সমাধানে আসেন।’ সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *