জয়ের পথভোলা বাংলাদেশের আরেকটি হার

Slider খেলা

মোহাম্মদ রিজওয়ান সিঙ্গেল নিতেই গ্যালারিতে উৎসব। হুট করে মনে হতে পারে খেলা কলকাতায় নয়, হচ্ছে করাচিতে। ম্যাচটি দেখতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি সমর্থক এলেও পাকিস্তানের সমর্থকও কম ছিল না। বাংলাদেশের ব্যাটারদের কোনও উইকেট কিংবা পাকিস্তানের ব্যাটারদের কোনও বাউন্ডারি, উল্লাসে ফেটে পড়ে গ্যালারি। এই আনন্দ আরও ছড়িয়ে পড়েছে বাবর আজমরা যখন হারের বৃত্ত ভেঙেছে। দারুণ শুরুর পর টানা চার ম্যাচ হেরে সেমিফাইনালের পথটাই কঠিন করে ফেলেছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশকে ৭ উইকেটে হারিয়ে সেমিফাইনালের ক্ষীণ সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখলো তারা।

২১ দিন পর বিশ্বকাপে জয়ের দেখা পেলো পাকিস্তান, চার ম্যাচ হারের পর। ইডেন পাকিস্তানকে বরাবরই দুই হাত ভরে দিয়েছে। আগে খেলা ছয় ম্যাচের পাঁচটিতেই জিতেছে তারা। এবারও টানা হারের মধ্যে আটকে থাকা পাকিস্তান ইডেনে এসে হারের বৃত্ত ভেঙেছে। এমন কিছুর জন্যই ইডেনের গ্যালারিতে পাকিস্তানের সমর্থকদের অপেক্ষা ছিল। ম্যাচের পুরোটা সময় বাবরদের উৎসাহ দিয়ে গেছেন তারা। ম্যাচ শেষে গ্যালারির এক কোণায় জড়ো হন হাজার দুয়েক দর্শক। নিরাপত্তার কারণে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছিলেন না তারা। তবুও কোণায় দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের নাম ধরে ডেকে ডেকে স্লোগান তুলেছেন। তাতে সাড়াও দিয়েছেন বাবররা।

অন্যদিকে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের উল্টো চিত্র। ড্রেসিংরুমের পেছনে ও পাশে থাকা দর্শকরা গ্যালারি থেকে ক্রিকেটারদের উদ্দেশ্যে দুয়োধ্বনি দেন। ‘ভুয়া-ভুয়া’ স্লোগান শুনে ক্রিকেটাররা যেন মুখ লুকালেন। দ্রুত চলে গেলেন ড্রেসিংরুমে। এভাবে লণ্ডভণ্ড হওয়ার পর কোনোভাবে কি আর মুখ দেখানো সম্ভব! সংবাদ সম্মেলনে মেহেদী হাসান মিরাজ তো দায়টা নিজেদের ঘাড়েই নিয়ে নিয়েছেন। এমনিতে ম্যাচের পুরোটা সময় বাংলাদেশ দলকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে গেছেন দর্শকরা। পাকিস্তানের সমর্থকদের সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও গর্জন করেছেন সাকিবদের জন্য।

পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাটিং ব্যর্থতাই ডুবিয়েছে বাংলাদেশ দলকে। আজকের ম্যাচেও ভিন্ন কিছু হয়নি। ইডেনে টস জেতার সুবিধা কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। প্রথম ওভারেই ওপেনার তানজীদ হাসান তামিমকে হারায় বাংলাদেশ। তরুণ বাঁহাতি এই ওপেনারকে ফিরিয়ে ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট পূর্ণ করেন পাকিস্তানের তারকা পেসার শাহীন শাহ আফ্রিদি, যা ওয়ানডেতে পেসারদের মধ্যে দ্রুততম। রানের খাতা খোলার আগেই এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়ে সাজঘরে ফেরেন তানজীদ। বিশ্বকাপে সাত ম্যাচের মধ্যে তিনটিতে দুই অঙ্কের রান করতে ব্যর্থ হলেন তিনি। ৭ ম্যাচে তার রান ১০০।

এক ওভার পরেই শাহীনের শিকার নাজমুল হোসেন শান্ত। দারুণ ফর্ম নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে এলেও ছিলেন ছায়া হয়েছে। ৭ ম্যাচের মধ্যে একটি ম্যাচে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতে পেরেছেন এই ব্যাটার। ধর্মশালায় আফগানদের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে খেলেছিলেন ৫৯ রানের অপরাজিত ইনিংস। বাকি ম্যাচগুলোর স্কোর মনে হতে পারে কোনও মোবাইল নম্বরের ডিজিট। আজ মুশফিককে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন দেওয়া হয়। কয়েক ম্যাচ আগেও ছয় নম্বরে নেমে ভালো খেলেছিলেন উইকেটকিপার এই ব্যাটার। ফলে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল, মুশফিক-মাহমুদউল্লাহকে কেন এত নিচে ব্যাটিং করানো হচ্ছে। মঙ্গলবার মুশফিককে উপরে উঠানো হলেও সফল হননি তিনি। হারিস রউফের বলে উইকেটে পেছনে রিজওয়ানের হাতে তালুবন্দি হন। খেলেন ৮ বলে ৫ রানের ইনিংস।

২৩ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর লিটন দাস ও মাহমুদউল্লাহর জুটিতে বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশ। চাপ কাটিয়ে সাবলীল ব্যাটিংই করছিলেন তারা। কিন্তু দলীয় সংগ্রহ ১০০ ছাড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ক্যাচ অনুশীলন করিয়ে বিদায় নেন লিটন। এমন আউট যে সবার জন্যই হতাশার, লিটনের শারীরিক ভাষাই সেটা বলে দিচ্ছিল। আউট হওয়ার পর নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ডানহাতি এই ওপেনার। তাতে ভেঙে যায় ৭৯ রানের গুরুত্বপূর্ণ জুটি।

২১তম ওভারে ইফতিখার আহমেদের করা পায়ের উপরের ডেলিভারি ঘুরিয়ে খেলতে গিয়ে মিড উইকেটে আগা সালমানের হাতে ক্যাচ তুলে বিদায় নেন লিটন। আউট হওয়ার আগে খেলেন ৬৪ বলে ৬টি চারে ৪৫ রানের ইনিংস।

এরপর মাহমুদউল্লাহও বেশি সময় টিকতে পারেননি, তবে তিনি হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন। এটা তার বিশ্বকাপের তৃতীয় ও এবারের আসরের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি। শাহীনের বলে বোল্ড হওয়ার আগে ৭০ বলে ৬ চার ও এক ছক্কায় ৫৬ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।

এক ম্যাচ পর একাদশে ফিরেছিলেন তাওহীদ। কিন্তু ভালো খেলতে পারেননি। ছক্কা মারার পরের বলেই স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ৭ রান করে আউট হন মিডল অর্ডার এই ব্যাটার। ১৪০ রানে ৬ উইকেট হারানো দলে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফেরান সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ। সপ্তম উইকেটে ৪৫ রান যোগ করেন তারা। যদিও ব্যাটিংয়ে নেমে শুরু থেকেই অস্বস্তিতে ছিলেন সাকিব। এক ওভারে ইফতিখারকে টানা তিনটি চার মেরে হাত খুলছিলেন। এরপর ছন্দ মিললেও বেশি পথ আগানো হয়নি তার। ৬৪ বলে ৪টি চারে ৪৩ রান করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।

এরপর লড়াই করতে থাকা মিরাজকে ফিরিয়ে চোখের পলকেই বাংলাদেশকে ২০৪ রানে অলআউট করে দেয় পাকিস্তান। মিরাজ ৩০ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ২৫ রান করেন।

আগুনে বোলিংয়ে শুরুতেই বাংলাদেশকে দিক ভুলিয়ে দেওয়া পাকিস্তানের বাঁহাতি পেসার শাহী ১০ ওভারে এক মেডেনসহ মাত্র ২৩ রান খরচায় ৩টি উইকেট নেন। বাংলাদেশের শেষের ৩ উইকেট নেওয়া ওয়াসিম ৮.১ ওভারে ৩১ রান দেন। হারিস ২টি এবং ইফতিখার ও উসামা মীর একটি করে উইকেট পান।

স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মামুলি এই সংগ্রহ পাকিস্তানের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ফখর জামানের ৭৪ বলে ৮১ এবং আব্দুল্লাহ শফিকের ৬৯ বলে ৬৮ রানের সুবাদে সহজেই জয়ের পথে এগিয়ে যায় পাকিস্তান। দুই ব্যাটার মিলে বাংলাদেশের বোলারদের ওপর চড়াও হন। সাকিবকে বিশাল ছক্কা মেরে বলই হারিয়ে ফেললেন শফিক। ১২৭ বলে ১২৮ রানের জুটি গড়ে সাকিব-মিরাজদের যেন পাড়ার বোলার বানিয়ে ফেলেন পাকিস্তানের দুই ওপেনার।

এরপর তিন উইকেট হারালেও পাকিস্তানের জয় পেতে কোনও সমস্যা হয়নি। ১০৫ বল হাতে রেখে ৭ উইকেটে বাংলাদেশকে হারিয়ে হারের বৃত্ত ভাঙতে পেরেছে ছন্দ হারানো পাকিস্তান।

বাংলাদেশের বোলারদের কাউকেই পাকিস্তানের ব্যাটাররা পাত্তা দেননি। ৬০ রান খরচায় অফস্পিনার মিরাজ শিকার করেছেন তিনটি উইকেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *