ফের সংলাপের তাগাদা

Slider রাজনীতি


নির্বাচনী সঙ্কট সমাধানে ফের সংলাপের সুর বেজে উঠেছে। নতুন করে এই তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। ঢাকা সফরকালে মার্কিন এই দলটি কমপক্ষে ২০টি বৈঠক করে এক বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিতে অর্থবহ একটি সংলাপের ওপর জোর দিয়েছে। মার্কিন এই তাগাদার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিবদমান দুইটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংলাপ নিয়ে তাদের স্ব স্ব অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। দুইটি দলই সংলাপে বসতে রাজি আছে, তবে কেউই ‘শর্তহীনভাবে’ বসতে রাজি নয়।

আওয়ামী লীগ ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার’ নিয়ে কোনো আলোচনায় বসতে চায় না। আর বিএনপির মূল দাবি এটিই।
সংলাপের ‘অভিজ্ঞতা তিক্ত’ হওয়ায় বিএনপি নতুন করে এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে আগ্রহী নয়। দলটির নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এমন ঘোষণা এলেই তারা কেবল সংলাপে বসবেন, এর আগে নয়।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানোর বিষয়টি মূল্যায়ন করতে গত ৭ অক্টোবর ঢাকায় এসেছিল মার্কিন পর্যবেক্ষক টিম। ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সমন্বয়ে গঠিত মার্কিন প্রতিনিধিদলটি ঢাকা সফরকালে অন্তত ২০টি বৈঠক করে।

সফর শেষে ওয়াশিংটনে ফিরে মার্কিন প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। ১৪ অক্টোবর দেয়া ওই বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশনসহ অংশীজনদের কাছে পাঁচটি সুপারিশ রেখেছে পর্যবেক্ষক দল।

বিবৃতিতে বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ সংলাপে বসতে বলেছে প্রতিনিধিদলটি।

প্রতিনিধিদলটি দলটি মনে করে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধানসহ বাস্তবসম্মত, দীর্ঘস্থায়ী ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর খোলামনে আলোচনায় যুক্ত হওয়া উচিত।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে আলোচনায় যাবে না আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগ শর্তযুক্ত কোনো সংলাপে রাজি নয়। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে কোনো আলোচনায় যাবে না তারা। আওয়ামী লীগের অবস্থান, তারা সংবিধানের বাইরে যাবে না। সংবিধানের বাইরে গিয়ে কারো কোনো পরামর্শও বিবেচনা করা হবে না। আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচন হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। শিগগিরই নির্বাচনকালীন অন্তরবর্তী সরকার গঠন করা হবে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বিএনপি শর্ত প্রত্যাহার করলে সংলাপের বিষয়টি চিন্তা করে দেখা হবে বলে গতকাল জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের পাঁচ দফা সুপারিশের বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পর্যবেক্ষক দলের সাথে আমাদের অনেক আলোচনা হয়েছে। বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, নির্বাচন কমিশন বাতিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। বিএনপি সবার আগে চায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ। এসব শর্ত রেখে সংলাপ হতে পারে না।’

মার্কিন প্রতিনিধিদল আমাদের সাথে আলোচনা করার সময় সংলাপের বিষয়ে কোনো কথা হয়নি বলেও জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘তারা কোথা থেকে সংলাপের কথা আনলো, তা বুঝতে পারছি না। ওদের (বিদেশী) কথায় ইলেকশন হবে না। ইলেকশন আমাদের নিজস্ব বিষয়। ওরা বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে সুপারিশ করতেই পারে।’

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে সংবিধান বা প্রচলিত আইনে যা আছে, তার বাইরে কোনো সংলাপ হতে পারে না তার মতে, সংবিধান ও আইন মেনে যদি কেউ নির্বাচনে আসে, তাহলে আলোচনারও প্রয়োজন থাকে না।
সংলাপ নিয়ে বিএনপির অভিজ্ঞতা তিক্ত : বিএনপি সংলাপ নিয়ে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছে। বিএনপি বলেছে, ২০১৩ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এবং সুশীলসমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সাথে পৃথকভাবে বৈঠক করেন। তবে সঙ্কট নিরসনে তিনি সফল হননি। তখন বলা হয়েছিল, সরকার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে ওই নির্বাচন করেছিল। দ্রুত সময়ের মধ্যে আরেকটি নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও আওয়ামী লীগ সরকার তা রক্ষা করেনি।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি। ওই সংলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, সংলাপে প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, নির্বাচনে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই, প্রার্থীদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, গায়েবি মামলা দিয়ে নির্বাচনী মাঠ ফাঁকা করে ফেলা হয়েছে, নির্বাচনের আগের রাতে ভোট ডাকাতি করা হয়েছে। ওই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে তারা এবার সরকারের সাথে এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে যেতে আগ্রহী নয়।

তবে বিএনপির কোনো কোনো নেতা বলেছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এতদিন অনঢ় অবস্থানে থাকলেও পশ্চিমাদের চাপে সঙ্কট সমাধানে তারা সংলাপে বসবে এবং সেই সংলাপ তফসিল ঘোষণার আগেও হতে পারে।

এখন কেউ যদি অনঢ় অবস্থানে থাকেন, তাহলে সঙ্কট সমাধান হবে না। দুই দলকেই মাঝামাঝি জায়গায় আসতে হবে। আর যদি সংলাপ ফলপ্রসূ না হয় তাহলে ক্ষমতাসীনরা ভিসানীতিসহ বহির্বিশ্বের বিশেষ করে পশ্চিমাদের নানা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি সংলাপ প্রসঙ্গে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বিএনপি সংলাপের দরজা বন্ধ করেনি। তবে সংলাপের আগে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের ঘোষণা দিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *