রিজার্ভের শর্ত পূরণ না হওয়ায় দ্বিতীয় কিস্তি অনিশ্চিত

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য বেশ কিছু শর্ত মানার প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ জুন মাসের মধ্যে দুই হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার রাখতে হবে। আর সেপ্টেম্বরে তা দুই হাজার ৫৩০ ডলার এবং ডিসেম্বরে দুই হাজার ৬৮০ ডলারে রাখতে হবে। এই শর্ত মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার প্রেক্ষিতে গত জানুয়ারির শেষ দিকে আইএমএফ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ইতোমধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ছাড় করা হয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার কথা আগামী নভেম্বরে। কিন্তু আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল তা পূরণ হয়েছে কি না তা জানতে আইএমএফের প্রতিনিধিদল ইতোমধ্যে ঢাকায় এসেছে।

আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার সাথে ১৪ দিনের সিরিজ বৈঠক আজ শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। আজ বুধবার সকাল ৯টায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গভর্নর, তিন ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক হবে। তবে, সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দ্বিতীয় কিস্তির ছাড়ের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম প্রধান দু’টি শর্ত পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। এক দিকে শর্তানুযায়ী জুন ও সেপ্টেম্বরের রিজার্ভ রাখতে পারেনি, অপরদিকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন হয়নি। সবমিলেই আইএমএফ তার শর্তে অনড় থাকলে দ্বিতীয় কিস্তির ছাড় নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে রিজার্ভের শর্ত থেকে অব্যাহতি চাওয়া হবে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী গত ২৭ সেপ্টেম্বরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ (আন্তর্জাতিক হিসাব পদ্ধতি-বিপিএম৬) অনুযায়ী ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। যেখানে সেপ্টেম্বর শেষে রাখার কথা ছিল ২৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। আবার জুন শেষেও প্রকৃত যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখার কথা ছিল তা ছিল না। এর অন্যতম কারণ হলো বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহ কমে গেছে বহিঃপ্রবাহের তুলনায়। প্রতি মাসেই রিজার্ভ থেকে সরকারি কেনাকাটার দায় মেটাতে সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। আর এ কারণেই প্রতি মাসেই গড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক বিলিয়ন করে কমে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিপিএম৬ অনুযায়ী আইএমএফের কাছে যে পরিমাণ রিজার্ভ দেখানো হচ্ছে তাও মানতে চাচ্ছে না আইএমএফ। তারা বলছে, এ থেকে কমপক্ষে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার কম প্রকৃত রিজার্ভ। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, প্রতি দুই মাসের এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের দায় তৃতীয় মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধ করতে হয়। গড়ে প্রতি মাসেই আকুর দায় পরিশোধ করা হয় সোয়া এক বিলিয়ন ডলার। সুতরাং নিট রিজার্ভ থেকে এ অর্থ বাদ দিতে বলছে আইএমএফ। ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা ১.২৫ বিলিয়ন ডলার ও স্পেশাল ড্রয়িং রাইট (এসডিআর) হিসেবে থাকা ২.০৪ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বিপিএম৬ অনুযায়ী যে রিজার্ভ দেখানো হচ্ছে তা থেকে এ অর্থও বাদ দিতে বলছে আইএমএফ। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি মাসে রিজার্ভের যে লিখিত হিসাব আইএমএফের কাছে দেয়া হচ্ছে তা জনসম্মুখে বা কোথাও তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এমন এক সময়ে আইএমএফের প্রতিনিধিদল এসেছে যখন বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের অন্যতম প্রধান খাত রেমিট্যান্স কমে (সেপ্টেম্বরে) ১.৩ বিলিয়নের ঘরে নেমেছে যা বিগত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। রফতানি আয়ও কমে গেছে। এমনিতেই শর্তানুযায়ী রিজার্ভ নেই, এর ওপর বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহের খাতগুলো নিম্নমুখী হওয়া বড় চিন্তার কারণ হয়ে পড়েছে। সফররত আইএমএফের প্রতিনিধিদলকে আগামীতে রিজার্ভ বাড়ানোর কিসের ওপর প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে তা নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা। তবে, প্রাথমিকভাবে রিজার্ভ গণনার আন্তর্জাতিক এ পদ্ধতি থেকে অব্যাহতি চাওয়া আইএমএফের কাছে।

এ দিকে, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের অন্যতম আরো একটি শর্ত ছিল রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় কমেছে ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আইএমএফ ঋণের শর্ত হিসেবে জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। কিন্তু সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। এ নিয়ে এক ধরনের সংশয়ের মধ্যে রয়েছে অর্থ বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কেন রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে, এর ব্যাখ্যাও তুলে ধরা হবে সফররত আইএমএফের মিশনের কাছে। পাশাপাশি এ শর্ত পূরণ থেকেও অব্যাহতি চাওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় দেয়া হবে কি না তা নির্ভর করছে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের ওপর। সফররত আইএমএফের প্রতিনিধিদল অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন সংস্থার সাথে সিরিজ বৈঠক করবে আগামী ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত। তারা এসব বৈঠকের সারসংক্ষেপ আইএমএফের বোর্ডে উপস্থাপন করবে। বোর্ডই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে চলতি মাসের শেষের দিকে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *