বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস আজ

Slider জাতীয়


চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে ৩৬১ শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছেন। এদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ২১৪ জন, যাদের প্রায় ২৬ শতাংশই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন অভিমান থেকে। এ ছাড়া আত্মহনন করা ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর বয়স ১৯ বছরের নিচে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারিভাবে সমন্বিত কার্যক্রম না থাকায় আত্মহনন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যে জোর দেওয়ার তাগিত দিয়েছেন তারা।

বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেশে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। সেখানে গত বছর তা পাঁচগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩২ জনে। আর চলতি বছর আত্মহত্যা করেছেন ৩৬১ জন। বছর শেষে এ সংখ্যা গত বছরকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আজ রবিবার বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ^ আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্যÑ কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি কর।’

আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, চলতি বছর আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে স্কুলগামী শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি; ১৬৯ জন (প্রায় ৪৭ শতাংশ)। এ ছাড়া কলেজগামী ২৬ শতাংশ, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ১৮ শতাংশ এবং মাদ্রাসাশিক্ষার্থী রয়েছে ৮ শতাংশ। বিভাগ

অনুযায়ী, এ বছর সবচেয়ে বেশি (৩১ শতাংশ) আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। সবচেয়ে কম সিলেটে; ২ দশমিক ৫ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাবা-মায়ের সম্পর্কে অস্থিরতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ না থাকা, চলমান সামাজিক অস্থিরতা, কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও স্থানীয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় শিশু থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। এ জন্য আত্মহত্যা মোকাবিলায় জরুরি হলোÑ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, পারিবারিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতার পাঠ শেখানো।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কবির হোসেন ও রুমা বেগম দম্পতির মেয়ে তাশফিয়া (৯)। পরিবারের বকাঝকা সহ্য করতে না পেরে গত ১৭ জুন গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে চতুর্থ শ্রেণির এ মাদ্রাসাশিক্ষার্থী।

তাশফিয়ার মা রুমা বেগম বলেন, ‘দুষ্টুমি করায় বকাঝকা করা হলে জিদের বসে ঘরের পিলারের সঙ্গে গলায় ওড়া পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। পরে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’

শুধু প্রাথমিকের শিক্ষার্থী নয়, আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। গত ১ সেপ্টেম্বর প্রেমিককে ভিডিওকলে রেখে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী সামিতা আশকা।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সদস্য ফারজানা আক্তার লাবনী গতকাল এক অনুষ্ঠানে জানান, নারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ বিবেচনায় দেখা যায়, ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী অভিমান থেকে, প্রেমঘটিত কারণে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদের কারণে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, যৌন হয়রানির কারণে ৫ দশমিক ১০ শতাংশ এবং পড়াশোনার চাপ ও ব্যর্থতার কারণে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ আমাদের সময়কে বলেন, ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তবে এখনো সেগুলো প্রক্রিয়াধীন। স্কুলগুলোতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়ার কথা রয়েছে, পাঠ্যবইয়েও মানসিক স্বাস্থ্যে জোর দেবে বলে জানিয়েছে। তবে প্রান্তিক পর্যায়ে এখনো সেবার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি, যা আছে শহরকেন্দ্রিক।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে অনেকে রোগ হিসেবে নিতে নারাজ। বর্তমানে ঢাকার বাইরেও সেবা মিলছে। তবে কিছু কাজে গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশেজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন এবং একটি টোল ফ্রি জাতীয় হটলাইন নম্বর চালু করা দরকার।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ৩৫০ জন এবং মনোবিজ্ঞানী রয়েছেন ৫৬৫ জন। মানসিক চিকিৎসায় ৯১৫ বিশেষজ্ঞের অধিকাংশই ঢাকায় কর্মরত। ঢাকার বাইরে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তেমন পদ নেই। ফলে চাইলেও সেবা দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়টি স্বীকার করে অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শহীদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, এত অল্প জনবল দিয়ে সারাদেশের মানুষকে সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য বিশ^ স্বাস্থ্য নির্দেশিত এইচপিএনএসপি সেক্টর প্রোগ্রামের আওতায় সরকার প্রথমবারের মতো একটি ডেডিকেটেড অপারেশন প্ল্যান ‘মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ডিসঅ্যাবিলিটি (এমএইচডি)’ হাতে নিয়েছে। এই প্রোগ্রামের আওতায় উপজেলা পর্যায় থেকে ডাক্তার ও নার্স এনে ঢাকায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পূর্ণভাবে সম্ভব না হলেও মনোরোগ ও মনোবিজ্ঞানীর ঘাটতি কিছুটা হলেও তারা পূরণ করছেন। তিনি বলেন, আগামী বছরের জুলাই থেকে প্রাথমিকভাবে ৩২ জেলায় ‘মেন্টাল হেলথ ইউনিট’ করার পরিকল্পনা আছে। সরকার অনুমোদন দিলেই এটি এগোবে। যেখানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি ফিজিও এবং ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।

তবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার রোগীদের কী পরিমাণ রোগী চিকিৎসার আওতায় আসছে কিংবা বাইরে থাকছে, সেই পরিসংখ্যান নেই সরকারের হাতে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, দেশের ২১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তবে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসছেন ১০ শতাংশেরও কম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোরশেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও পারিপাশির্^ক অবস্থার জন্য ক্রমেই মানুষের মাঝে হতাশা বাড়ছে। ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। মানসিক স্বাস্থ্য অবস্থা আরও শোচনীয় হচ্ছে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা পারিবারিক বন্ধনগুলো ভালো যাচ্ছে না, প্যারেন্টিং ঠিকমতো হচ্ছে না। কোভিডের প্রভাবে লেখাপড়ায় যে দীর্ঘ গ্যাপ তৈরি হয়েছে, সেটি কুলিয়ে উঠতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।’ তিনি বলেন, ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে অনেকে অনেকভাবে কাজ করছে। তবে সমন্বিত কাজ করতে পারলে আরও এগোনো সম্ভব। ঢাকার বাইরের এখনো সেভাবে কাউন্সেলিংয়ের বিষয়টি গড়ে ওঠেনি। সবচেয়ে বেশি জরুরি স্কুলগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া। এখন পর্যন্ত যা সম্ভব হয়নি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *