মুঠোফোন ঘেঁটে গ্রেপ্তার হয়রানির অভিযোগ

Slider সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী


বাস থামিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, মহাসমাবেশে যাচ্ছি কিনা। আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি বলার পরও মুঠোফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। তবে বাটন ফোনে কিছু না পেলেও পুলিশ কর্মকর্তা বিশ^াস করতে পারছিলেন না। পরে যার বাসায় যাচ্ছি, সেই আত্মীয়কে ফোন করতে বলেন। ঢাকায় থাকা এক আত্মীয়কে ফোন করলে তিনি জানান, তার বাসাতেই যাচ্ছি। এরপর পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয় বলে আমাদের সময়কে জানান মানিকগঞ্জের ঘিওর থানার সিঞ্জুরী ইউনিয়নের শ্রমিক দলের সভাপতি কিসমত আলী। গতকাল সকালে ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় এমন পুলিশি তল্লাশির মুখে পড়েন তিনি।

শুধু কিসমত আলীই নয়, বিএনপির সমাবেশে আসা ১২ নেতাকর্মীর সঙ্গে আমাদের সময় কথা বলেছে। যারা সমাবেশে আসার সময় হয়রানি ও তাদের মুঠোফোন ঘেঁটে দেখার অভিযোগ করেছেন। মোবাইলে থাকা একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় অন্য কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করছে, এটাকে খুবই অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর বলে তাদের অভিযোগ।

আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আদালতের আদেশ ছাড়া কোনোভাবেই মুঠোফোন তল্লাশি করার এখতিয়ার কারো নেই। কারণ এই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার তাকে সংবিধানে দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো মামলার অংশ হিসেবে মোবাইল ফোন আদালতে উপস্থাপন করা হয় তাহলেই কেবল তদন্তকারী ব্যক্তিরা সেটা দেখতে পারবেন। সংবিধানে নাগরিকদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার যে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, মুঠোফোন ঘাঁটাঘাঁটি সেটির গুরুতর লঙ্ঘন। সেজন্য সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন।

ঢাকার ধামরাই উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, তার ইউনিয়ন থেকে ২২ নেতাকর্মী শুক্রবার সকালে মহাসমাবেশে এসেছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে বাসে করে ঢাকার দিকে রওনা হন। ধামরাইয়ের ইসলামপুর ও আমিনবাজার এলাকায় তাকে আটকায় পুলিশ। আমিনবাজার এলাকায় তার মোবাইল নিয়ে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে। ম্যাসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপে কার সঙ্গে কী চ্যাট হয়েছে এবং ফেসবুকে কী স্ট্যাটাস দিয়েছি সেটাও চেক করা হয়। আগেরবারের অভিজ্ঞতায় তিনি চ্যাট এবং স্ট্যাটাস ডিলেট করে দিয়েছিলেন। তাই তার মোবাইলে বিএনপিপন্থি তেমন কিছু না পেয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। তবে তাদের সঙ্গে আসা কয়েকজনকে আটক করে নিয়ে গেছে পুলিশ।

এদিকে বিএনপির সমাবেশে আসা অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার এড়াতে নিজেদের স্মার্টফোন বাসায় রেখে বাটন ফোন নিয়ে আসেন। তাদেরই একজন টাঙ্গাইলের সখীপুরের সবুর রেজা। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, তাদের থানা থেকে ৭টি বাস নিয়ে বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। সখীপুরের চোয়ানা বাজার এলাকায় আসার পর তিনটি বাস আটকে দেয় পুলিশ। মুঠোফোন ঘেঁটে ঘেঁটে বাসে থাকা নেতাকর্মীদের অনেককেই আটক করা হয়। আগেরবারের অভিজ্ঞতায় এবার তিনি বাটন ফোন নিয়ে এসেছেন। এই ফোনে কয়েকটি নম্বর ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই পুলিশ কিছু খুঁজে পায়নি।

টাঙ্গাইলের সখীপুরের যাদবপুর ইউনিয়নের বিএনপি কর্মী জিয়া হাবিব আমাদের সময়কে বলেন, তিনি কোনো মুঠোফোনই এবার নিয়ে আসেননি। কারণ ফোন থাকলেই পুলিশ ঘাঁটাঘাঁটি করবে। কিছু না পেলে আত্মীয়স্বজনদের ফোন দিয়ে ঝামেলা করবে।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাড. তাপস কান্তি বল আমাদের সময়কে বলেন, সন্দেহভাজন যে কোনো ব্যক্তিকেই পুলিশ সার্চ করতে পারবে। কিন্তু মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটির মাধ্যমে যখন আপনি প্রাইভেসির জায়গাটা ক্রস করে যাচ্ছেন, তখনই আপনি সংবিধান এবং আইনের লঙ্ঘন করছেন। এখন পুলিশ যদি মোবাইল সার্চ করতেই চায়, তাহলে আইন করে কতটুকু করবে এবং কেন করবে সেটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন।

জানা গেছে, ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীর আবদুল্লাহপুরে যাত্রীবাহী বাস, মোটরসাইকেল ও যেকোনো যানবাহনে আসা যাত্রীদের মুঠোফোন ঘেঁটে ৩০ জনকে আটক করে পুলিশ।

উত্তরা পূর্ব থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, আটকরা দলবদ্ধ হয়ে বিএনপির মহাসমাবেশে যাচ্ছিল। বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় তাদের আটক করা হয়। তবে আটকদের দাবি, পুলিশ কোনো কারণ ছাড়াই তাদের আটক করে। মুঠোফোন ঘেঁটে বিএনপি সংক্রান্ত কোনো ছবি বা বার্তা পেলেই তাদের আটক করা হয়। ঢাকার সাভারের আমিনবাজার এলাকার তল্লাশিচৌকিতে গতকাল দুপুর পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে আটকের খবর পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তারাব সুলতানা কামাল সেতু এলাকায় ঢাকামুখী বাস, প্রাইভেটকারে তল্লাশির পাশাপাশি যাত্রীদের কাছে ঢাকায় যাওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়। অনেক যাত্রীর মুঠোফোন তল্লাশি করেছে। অনেককে পুলিশ নাম-পরিচয় ও মুঠোফোন নম্বর লিখে রেখে বাড়িতে ফেরত পাঠান। ঢাকার কেরানীগঞ্জের বছিলা সেতুর কাছে ঘাটারচর এলাকায়, বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর কাছে কদমতলী এলাকায় এবং ঢাকা-মাওয়া সড়কের বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় ঢাকাগামী যানবাহনগুলোতে তল্লাশি করেছে পুলিশ। এসব এলাকা থেকে মুঠোফোন ঘেঁটে অন্তত ৫০ জনকে আটকের খবর পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, শুক্রবার সকালে ব্যক্তিগত কাজে ফরিদপুর থেকে তিনি ঢাকায় আসছিলেন। তিনি কোনো রাজনীতি করেন না। পথিমধ্যে পুলিশ বাস থামিয়ে তল্লাশি করে। এ সময় স্মার্টফোন নিয়ে পুলিশ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমু ও ম্যাসেঞ্জারের মেসেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে। তিনি অভিযোগ করেন, মুঠোফোন মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত জিনিস। রাজনীতির বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, ছবি বা গোপনীয় জিনিস থাকতে পারে। কিন্তু তল্লাশির নামে পুলিশের মোবাইল দেখাটা খুবই বিব্রতকর এবং একই সঙ্গে অপমানজনক। আমাদের কোনো ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

মুঠোফোন ঘাঁটাঘাঁটি করার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, এ ধরনের কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *