সরকারের সামনে গুচ্ছ গুচ্ছ দাবি

Slider রাজনীতি

নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নানা কর্মসূচিতে রাজপথে রয়েছে বিএনপিসহ একাধিক দল ও জোট। তাদের মোকাবিলায় পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে রাজনীতির মাঠ ক্রমে উত্তপ্ত হচ্ছে। এর মধ্যে আবার বিভিন্ন দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবীরা। দাবি আদায়ে তারাও রাজপথে অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। নতুন পে-স্কেল ঘোষণা, চাকরি জাতীয়করণ, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, চাকরি স্থায়ীকরণসহ নানা দাবিতে পেশাজীবীরা মাঠে সোচ্চার। তারা তাকিয়ে আছেন সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে। জাতীয় নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, পেশাজীবীদের আন্দোলনের গতিপ্রবাহ ততই জোরালো হচ্ছে।

সরকারি কর্মচারীরা নতুন পে-স্কেলের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল জাতীয়করণের দাবিতে স্কুলে তালা ঝুলিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়েছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। মাসিক ৫০ হাজার টাকা ভাতার দাবিতে আন্দোলন করছেন পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি চিকিৎসকরা। চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে রেল চলাচল পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন রেলওয়ের অস্থায়ী শ্রমিকরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারীরা। দ্বিতীয় শ্রেণির দাবিতে আন্দোলনে নামতে চান প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা। প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতিবঞ্চিতরাও তাকিয়ে আছেন সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে।

গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেন সরকারি কর্মচারীরা। তারা চাকরিজীবীদের জন্য সরকারের ঘোষিত ৫ শতাংশ বিশেষ সুবিধার প্রজ্ঞাপন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, এ বিশেষ সুবিধা ১১ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য আরও বাড়াবে। তাই প্রণোদনা না দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যায়ে গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে বৈষম্যমুক্ত নতুন পে-স্কেল দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

মহার্ঘ ভাতা, গ্রেড বৈষম্য কমানো, নতুন পে-স্কেলসহ বিভিন্ন দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছে ‘বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে। পরিষদের নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান আমাদের সময়কে বলেন, ঐক্য পরিষদের নবম পে-স্কেলসহ ৭ দফা দাবি বাস্তবায়ন না করে অর্থ মন্ত্রণালয় ৫ শতাংশ বিশেষ সুবিধা দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা বর্তমান বাজারব্যবস্থা ও মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে প্রজাতন্ত্রের ১১ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা চরমভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। আমাদের মূল দাবি কর্মচারীদের বৈষম্য দূর করা।

কিন্তু তা না হয়ে ৫ শতাংশ বিশেষ সুবিধায় ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের বৈষম্য আরও বাড়বে। ১১-২০ গ্রেডের অধিকাংশ কর্মচারীর মূল বেতন ২০ হাজার টাকার নিচে। তাদের আগামী ৪ থেকে ৫ বছরেও বিশেষ সুবিধায় সর্বনিম্ন বেতন ১ হাজার টাকার বেশি বাড়বে না। অথচ প্রথম থেকে নবম গ্রেডের কর্মচারীদের এ সুবিধা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়বে। আমরা এ ধরনের বিশেষ সুবিধা চাইনি। আমরা চেয়েছি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের মূল বেতন বাড়ানো হোক।

তিনি বলেন, এ প্রণোদনা মূল বেতনের সঙ্গে যোগ না হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কর্মচারীরা। তাই আমরা চাই, দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করে বেতনবৈষম্য কমাতে ১০ ধাপে বেতন-ভাতা নির্ধারণ, পে-কমিশনে কর্মচারী প্রতিনিধি রাখা, সচিবালয়ের মতো সব দপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পদ ও পদবি এক এবং অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ন হোক। টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড, বেতন জ্যেষ্ঠতা পুনর্বহাল এবং সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে গ্র্যাচুইটির পরিবর্তে পেনশন প্রবর্তনসহ বিদ্যমান আনুতোষিকের হার ৯০ শতাংশের স্থলে ১০০ শতাংশ নির্ধারণ করা হোক। এসব দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা সন্তুষ্ট হব না।

এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে গত ১১ জুলাই থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) ব্যানারে এ অবস্থান শুরু হলেও একে একে শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠন একাত্মতা জানিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় বন্ধ করে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন শিক্ষকরা। এতে প্রেসক্লাবের উভয় পাশেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন কর্মসূচিস্থলে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথেই থাকবেন বলে জানিয়েছেন তারা।

গত বুধবার শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি। তবে ওই বৈঠকে শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। জাতীয়করণের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো আশ্বাস দিতে পারেননি। মন্ত্রী শুধু বলেছেন, নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের বিষয়ে দুটি কমিটি গঠন হবে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর এ আশ্বাসে সন্তুষ্ট নন শিক্ষকরা। জাতীয়করণের বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।

বিটিএর সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শেখ কাওছার আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা মাত্র ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা, ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। একই কারিকুলামে, একই সিলেবাসে পাঠদান করিয়েও সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। অথচ এসব বৈষম্য রেখেই বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা স্মার্ট করতে প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষক। এ জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ মাধ্যমিক শিক্ষা সরকারিকরণের বিকল্প নেই।’

এদিকে মাসিক ভাতা ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে আন্দোলনের মাঠে রয়েছেন পোস্টগ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকরা। গত রবিবার তারা তাদের কাজ বন্ধ করে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক আহ্বায়ক ডা. মো. হাবিবুর রহমান সোহাগ বলেন, ‘বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ২০ হাজার টাকায় পরিবার চলে না, নিজের চলাও মুশকিল। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম ভাতা দেওয়া হয় আমাদের দেশের ট্রেইনি ডাক্তারদের। তাই আমাদের দাবি, ভাতা ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হোক।’

গত রবিবার রাজধানীর এফডিসি সিগন্যালে চাকরি স্থায়ীকরণের দাবি ও আউটসোর্সিংয়ের প্রতিবাদে রেললাইন অবরোধ করেন রেলওয়ের অস্থায়ী শ্রমিকরা। ওই দিন সকাল ১০টায় এফডিসি রেলগেট এলাকায় রেললাইনের ওপর ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে অস্থায়ী শ্রমিকবৃন্দ’ ব্যানারে অবস্থান শুরু করেন তারা। ফলে ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের রেলযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরে বেলা আড়াইটার দিকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেনের আশ্বাসে রেলপথ ছাড়েন আন্দোলনকারীরা।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে মাঠে রয়েছেন নন-এমপিও শিক্ষকরা। তারা প্রতিনিয়তই তাদের কর্মসূচি পালন করছেন। দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্ত কলেজে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষকরাও এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলন করছেন। স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোও সরকারীকরণ চান ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা।

দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান ও সহকারী শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। প্রধান শিক্ষকরা এখন ১১তম গ্রেড এবং সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। তবে শিক্ষকদের সবাই দীর্ঘদিন ধরেই ১০ম গ্রেডে বেতন দাবি জানিয়ে আসছেন।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) জনবল কমানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন করছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। এ বিষয়ে বিএডিসি শ্রমিক-কর্মচারী লীগের (সিবিএ) সভাপতি মো. মশিউর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, তারা জনবল কাঠামো ৬৮০০ থেকে কমিয়ে ৩০১৭ জনে নামিয়ে আনার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। আমরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে তথা সরকারের শেষ সময়ে পেশাজীবীদের আন্দোলন তেমন একটা দানা বাঁধেনি। তবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। এ কারণে দাবি আদায় জোরালো আন্দোলনে নেমেছেন পেশাজীবীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *