ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে ৮ জেলা

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


চুয়াডাঙ্গা ছাড়া দেশের বাকি ৬৩ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী ডেঙ্গু ভাইরাস। এর মধ্যে ‘উচ্চঝুঁকিতে’ রয়েছে আট জেলা। এসব জেলায় চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০০ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা নির্মূলে কার্যকর উদ্যোগ না থাকা, সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত না করা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এডিস মশা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তবে দেশব্যাপী ছড়ালেও ডেঙ্গু সংক্রমণের হার এখনো সর্বোচ্চ পর্যায়ে (পিক) পৌঁছায়নি। আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের দিকে সেটা ঘটতে পারে। তার আগেই জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোসহ ডেঙ্গু মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ৬৩ জেলায় রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৬ জেলায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই শতাধিক। এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগী নেই শুধু খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গায়।

কীটতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, নিয়মিত ভর্তি শতকের কাছাকাছি থাকলে সে এলাকাকে রেড জোন কিংবা উচ্চঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগরীসহ আট জেলার ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। বাকি জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ফরিদপুর, গাজীপুর, চাঁদপুর, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর।

মাঠপর্যায়েও এসব জেলায় এডিস মশার ঘনত্ব ঢাকার মতোই বেশি। সম্প্রতি বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় এডিসের ঘনত্ব দেখতে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার।

গবেষণায় তিনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মতই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপ সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ ২০-এর ওপর পান; যা ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান এ গবেষক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা সবচেয়ে বেশি; প্রায় ১৮ হাজার। বর্তমানে ভর্তি আছেন সাড়ে তিন হাজারের বেশি। এর বাইরে ফরিদপুরে ১০৬ জন, গাজীপুরে ৯৭ জন, চট্টগ্রামে ২৩৫ জন, চাঁদপুরে ৯৬ জন, পটুয়াখালীতে ১১৫ জন, বরিশালে ২৪৩ জন এবং পিরোজপুরে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১০১ জন।

এ বছর ডেঙ্গুতে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার প্রায় ৯২ শতাংশই এসব মহানগরী ও জেলায়। এর মধ্যে ঢাকায় ১২২ জন, চট্টগ্রামে ২০ জন, বরিশালে তিনজন এবং ফরিদপুরে একজনের মৃত্যু হয়েছে।

কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার আমাদের সময়কে বলেন, ‘এসব শহর ও জেলায় ডেঙ্গু রোগীর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। কোন জেলা রেডজোনে আছে, সেটি বোঝা যায় মাঠপর্যায়ের গবেষণায়। জনসংখ্যার বিপরীতে সংক্রমণের হার ধরেও করা যেতে পারে। তবে যেহেতু সেটি নেই, তাই যেখানে শতকের কাছাকাছি রোগী ভর্তি আছে, সেগুলোকে আমরা সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ধরতে পারি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বরিশাল মহানগরীসহ জেলার আরও কয়েকটি জেলায় আমরা সরেজমিনে গিয়ে এডিসের ঘনত্ব দেখেছি। প্রতিটি জেলা ঝুঁকিপূর্ণের কাতারে পাওয়া গেছে। তবে সরকার মহামারী শব্দটি এক্ষেত্রে ব্যবহার করতে চায় না। কারণ অর্থনীতিসহ অনেক কিছু এর সঙ্গে জড়িত। তবে পরিস্থিতি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক, এটা স্পষ্ট। সামনে আরও খারাপ হবে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ ডেঙ্গু এখনো চূড়ায় পৌঁছায়নি।’

এরই মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১১টি এলাকাকে ‘রেডজোন’ ঘোষণা করেছে স্থানীয় সরকার। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) রয়েছে ছয়টি এলাকা- যাত্রাবাড়ী, মুগদা, কদমতলী, জুরাইন, মানিকনগর ও সবুজবাগ। উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পাঁচ উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকাÑ উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, তেজগাঁও ও বাড্ডা।

ডেঙ্গুর প্রথম প্রকোপের বছর ২০০০ সালে সাড়ে পাঁচ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। মৃত্যু হয় ৯৩ জনের। ওই সময় মহামারী ঘোষণার দাবি জানান রোগতত্ত্ববিদরা। তবে সরকার রাজি হয়নি।

এবারও পরিস্থিতি মহামারী পর্যায়ে যায়নি বলে মনে করছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, ‘ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা জারি অথবা মহামারীর মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।’

এদিকে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র কীÑ তা জানতে মাঠপর্যায়ে গবেষণা চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারি সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব এলাকায় আক্রান্ত রোগী বেশি, সঙ্গে নিয়মিত রোগী ভর্তির হার একশর কাছাকাছি, সেসব জেলায় এ গবেষণা চালানো হবে। শুরুতে রয়েছে গাজীপুর, কিশোরগঞ্জসহ ঢাকার নিকটবর্তী জেলাগুলো। এজন্য ১১ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন এ কমিটির প্রধান।

অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘গবেষণার জন্য অর্থ দেবে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গত বৃহস্পতিবার এ নিয়ে তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসেই গবেষণা শুরু হবে আশা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু সংক্রমণ নয়, এ বছর যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের অন্যান্য আর কী কী জটিলতা ছিল, বিশেষ করে কোমরবিডিটি ছিল কিনাÑ এমন তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। আগামী সোমবার পর্যন্ত এসব তথ্য নেওয়া হবে।’

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘ডেঙ্গুর পিক টাইম এখনো শুরু হয়নি। বিশ^ব্যাপী জ্বলবায়ুর যে প্রভাব, তাতে সামনে বৃষ্টি বাড়বে না কমবে, কেউ জানে না। পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকা-, যেখানে-সেখানে ভবন নির্মাণের কারণে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নিঃসন্দেহে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুর যে পরিস্থিতি সেটা মহামারী ঘোষণা মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। হুট করেই এমন পদক্ষেপে যাওয়া যায় না। কোনো সরকারই সে সিদ্ধান্তে যেতে চায় না। শুধু বৈজ্ঞানিক চিন্তা নয়, দেশের বিষয়টিও ভাবতে হবে। কারণ, এখানে অর্থনীতির বিষয়টি জড়িত। তবে আমরা অত্যন্ত বিপজ্জজনক অবস্থায় আছি; সামনে অবস্থা আরও শোচনীয় হবে।’

এই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুম চলছে। বর্তমানে যাদের জ্বর, সর্দি ও কাশি তার ৩০ শতাংশই ইনফ্লুয়েঞ্জা, পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ কোভিড এবং ১০ থেকে ১২ শতাংশ ডেঙ্গু। এর মধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা জটিল কিছু না, গুরুত্বপূর্ণ হলো সময়মতো হাসপাতালে আসা। জ্বর হলে বিশ্রাম কিংবা চিকিৎসা না নিয়ে অনেকে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। পরীক্ষা করতে চায় না, অবহেলা করে। কিন্তু ডেঙ্গু রোগীর জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি ফ্লুয়েড ম্যানেজমেন্ট। সঠিক সময়ে এটা না হলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি।’

ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধযোগ্য। ব্যক্তি সচেতনতা ও স্থানীয় সরকারের সঙ্গে জনসাধণের সম্পৃক্ততা কতটুকু, তার ওপর নির্ভর করে এর নিয়ন্ত্রণ। জনসম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। মশা বেশিদিন বাঁচে না, বেশিদূর যেতেও পারে না। এ জন্য ব্যক্তি তার বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখলে এডিস জন্মায় না। কিন্তু তাদের সে সচেতনতার কাজটি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তি, ইমাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততায় হবে।’

তিনি বলেন, ‘সরকার সহায়তায় দেবে; কিন্তু সুরক্ষা নিজেকেই নিতে হবে। কিন্তু আমরা হয়েছি উল্টো। ফলে যারা কীটনশাক ছিটিয়ে যায়, তারা বাসা মালিক কিংবা ভবনে বসবাসরতদের জিজ্ঞেস না করেই কীটনাশক দিয়ে যাচ্ছে। অথচ লার্ভা কোথায় তা জানে ভবনের বাসিন্দারা। এভাবে ডেঙ্গু থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়।’

এদিকে ভোলা (উত্তর) প্রতিনিধি জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজিব (২২) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। গতকাল সকালে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এটি ভোলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভোলা সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. তায়েবুর রহমান। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ২০ জন। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৪৫ জন। ভোলার সিভিল সার্জন ডা. কেএম শফিকুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় রোগীদের জন্য আরও ২০টি বেড বাড়ানো হয়েছে।

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, ডেঙ্গুতে জাহানারা বেগম (৩৯) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়। গতকাল ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। তার বাড়ী রাজবাড়ী সদর উপজেলার দ্বাদশী ইউনিয়নের আগমারা গ্রামে। জাহানারা ওই গ্রামের ইউনুছ হোসেনের স্ত্রী। ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. ছিদ্দীকুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে ৫২ রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে ১৬৩ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১০২ জন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *