মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে ওয়াইল্ড এলিফ্যান্ট ভ্যালি

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

এ এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। নদী, পাহাড়, ঝরনাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য দিয়ে ঘেরা। বলছিলাম চিরসবুজ বৃক্ষরাজিসমৃদ্ধ ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত চীনের ইউনান প্রদেশের শিসুয়াংবান্না ওয়াইল্ড এলিফ্যান্ট ভ্যালির কথা। সেখানে প্রবেশ করলে অনুভব করবেন বনের পিনপতন নিস্তব্ধতা। অসংখ্য বুনো গাছগাছালির শুকনো পাতার মর্মর আওয়াজ আলোড়িত করবে মনকে। প্রখর তাপ ও সূর্যের আলো ঘন জঙ্গলের গাছগাছালির ডালপালা কিংবা পাতা ভেদ করে মাটিতে পড়েনি কখনো। লোকালয় থেকে দূরে এমনই নির্জন প্রকৃতিকে একদল বন্যহাতির আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে চীন।

সূর্যের আলো পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করে এ বনের গাছপালা খুব উঁচু হয়ে থাকে, অনেক ওপরে ডালপালা ছড়িয়ে চাঁদোয়ার মতো সৃষ্টি করেছে, যা দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। বন্য হাতিদের আবাসস্থল হলেও বিভিন্ন ধরনের গাছগাছালি, পশুপাখি, কীট-পতঙ্গ এ বনের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পার্কে নিজেদের এলাকায় নিজেদের মতো

ঘোরাঘুরি আর সংসার পাতার সুযোগ এসব প্রাণীর। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে থাকে বন্যহাতিরা, কিন্তু চাইলেই নিজের এলাকা ছেড়ে বাইরেও যেতে পারে তারা। চীনা গণমাধ্যম সিজিটিএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাণীদের জন্য চীনের সর্বপ্রথম থিম পার্ক এই শিসুয়াংবান্না ওয়াইল্ড এলিফ্যান্ট ভ্যালি। বলা হয়ে থাকে, এটি হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যেখানে খুব কাছ থেকে নিরাপদে এশীয় হাতি দেখা যায়।

পার্কের ভিতরে প্রবেশ করে প্রফুল্ল মনে ঘুরে দেখতে পারবেন ও উপভোগ করবেন এর সৌন্দর্য। ঘন জঙ্গলের ভিতর হাঁটতে গিয়ে পিনপতন নীরবতায় দর্শনার্থীর গায়ে যেন শিহরণ লাগে। পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দে ভাঙে সেই নিস্তব্ধতা। পার্কের ভিতর কিছুটা ঘুরে দেখার জন্য কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ব্রিজ। ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা মেলে বন্যহাতির। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল। সাংবাদিকদের যে দলটিতে আমরা ছিলাম, আমরা দুটি হাতির দেখা পেয়েছিলাম। বনের ভিতর খুব কাছ থেকে বন্যহাতি দেখতে পাওয়ার আনন্দটাই আসলে অন্যরকম।

এই পার্কের হাতিরা অভয়ারণ্য থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে গিয়ে মানুষ বা ফসলের ক্ষতি করলে তার ক্ষতিপূরণের জন্য রয়েছে ইন্স্যুরেন্সের রক্ষাকবচ। প্রতিটি হাতির নামে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে প্রিমিয়াম পরিশোধ করে সরকার, মানুষের ক্ষতির হিসাবে পরিশোধ করা হয় বিমা দাবি।

শিসুয়াংবান্না ওয়াইল্ড এলিফ্যান্ট ভ্যালির কর্মীরা জানান, হাতির আক্রমণে মারা গেলে ৭ লাখ ইউয়ান (এক কোটি টাকার বেশি) পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে ফসলের ক্ষতি হলে হিসাব অনুযায়ী মেলে ক্ষতিপূরণ। এই অভয়ারণ্যে প্রায় তিনশ এশীয় হাতি রয়েছে। চিরহরিৎ বনের ভেতর দিয়ে হাতি দেখার জন্য রয়েছে প্রায় ৪ হাজার মিটার দীর্ঘ কাঠের তৈরি হাঁটার পথ। শিসুয়াংবান্না দাই অটোনোমাস প্রিফেকচারের প্রধান শহর জিনহং থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থান এই হাতি উপত্যকার। অভয়ারণ্যের বিস্তৃতি দুই লাখ ৪২ হাজার ৫০০ হেক্টর, যা শিসুয়াংবান্নার ভূমির ১২ শতাংশ।

ওয়াইল্ড এলিফ্যান্ট ভ্যালির কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ সালে সর্বপ্রথম ইউনান প্রদেশের বন্যপ্রাণীর সরকারি দায়বদ্ধতা ইন্স্যুরেন্সের পরীক্ষামূলক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। বাণিজ্যিক ইন্স্যুরেন্স মডেল প্রবর্তনের মাধ্যমে ২০১৪ সালে পুরো প্রদেশকে ইন্স্যুরেন্স কাভারেজের মধ্যে আনা হয়। সরকারি হিসাব বলছে, ২০২১ সালে ইন্স্যুরেন্সের পরিমাণ ৬৫ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন ইউয়ানে পৌঁছায়। চলতি বছর কেবল পুয়ার নগরী এবং শিসুয়াংবান্না প্রিফেকচারেই ইন্স্যুরেন্স করা হয় ৫০ মিলিয়ন ইউয়ানের। এশীয় হাতির ক্ষয়ক্ষতির কারণে ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৭ কোটি ৩০ লাখ ইউয়ান ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করেছে ইউনান প্রদেশ। একেক ধরনের ফসলের বিপরীতে বিভিন্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি একেক ধরনের ক্ষতিপূরণের হিসাব করে থাকে বলে জানান একজন কর্মকর্তা। যেমনÑ ভুট্টার জন্য প্রতি একশ বর্গমিটার ক্ষতির জন্য ১০৩ ইউয়ান এবং প্রতি একশ বর্গমিটার ধানের ক্ষতিতে ১৬২ ইউয়ান ক্ষতিপূরণ ধরা হয়।

এভাবে বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা এবং মানুষের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা সমানতালে করার কথা তুলে ধরে ইউনান প্রদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ক কার্যালয়ের উপ-মহাপরিচালক মা জুয়োশিন বলেন, এই বন্যহাতির অভয়ারণ্য আমাদের দেখাচ্ছে কীভাবে উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা যায়।

বাংলাদেশে ইন্স্যুরেন্সের এমন ব্যবস্থা না থাকলেও বন্যপ্রাণীর আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকারের তরফে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ২০২১ সালের বন্যপ্রাণীর দ্বারা আক্রান্ত জানমালের ক্ষতিপূরণ বিধিমালা অনুযায়ী, বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মৃত ব্যক্তি তিন লাখ টাকা, গুরুতর আহত ব্যক্তি সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা এবং সম্পদ নষ্টের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পাবেন।

ওই বিধিমালায় বলা হয়েছে, বন্যহাতি ছাড়াও বাঘ, কুমির, ভল্লুক বা সাফারি পার্কে থাকা বন্যপ্রাণীর দ্বারা আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করা যাবে। আমরা বন্যহাতিদের এই অভয়ারণ্যে দুই ঘণ্টার মতো সময় অতিবাহিত করেছিলাম। বন্যহাতি দেখতে পাওয়ার আনন্দ আর এলিফ্যান্ট ভ্যালির অপার্থিব সৌন্দর্য এখনো আমাকে বিমোহিত করে রেখেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *