মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের ফাঁসি যেকোনো দিন

Slider বাংলার মুখোমুখি


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপতি তাদের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন। এর মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও অধ্যাপক তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে চলমান সব দাপ্তরিক ও আইনি প্রক্রিয়া শেষ হল। এখন ফাঁসি কার্যকরে আর কোনো বাধা রইল না।

এদিকে বিষয়টি নিশ্চিত করে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল জানান, প্রাণভিক্ষার আবেদন রাষ্ট্রপতি নাকচ করার ফলে এখন দুই আসামির ফাঁসি কার্যকরে সব বাধা শেষ হলো। তবে ফাঁসি কার্যকর সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনা ও নথিপত্র রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আসার পর কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেবে। এজন্য কিছু সময়ও লাগবে।
মৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাবির ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম নিম্ন আদালতে মামলার রায় ঘোষণার পর থেকেই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নিজাম উদ্দিন মঙ্গলবার বিকেলে আমাদের সময়কে জানান, প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হওয়ার চিঠি এখনো এসে পৌঁছায়নি। চিঠি হাতে পেলে জেল কোড অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেল কোড অনুযায়ী সাধারণত ২১ দিনের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করার কথা। যেহেতু আইনি কোনো বাধা নেই, তাই চিঠি হাতে পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী যেকোনো দিন ফাঁসি কার্যকর করা হতে পারে।

এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও অধ্যাপক মিয়া মহিউদ্দিনের পরিবারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক মহিউদ্দিনের স্ত্রীর ভাই ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক নির্ঝর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২ মার্চ এই দুই আসামির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করেন সুপ্রিম কোর্ট। নিম্ন আদালতে দুজনের মৃত্যুদণ্ডের যে রায় দেওয়া হয়েছিল তাই বহাল থাকে আপিলে, খারিজ হয় রিভিউ আবেদনও। তাই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা ছিল না তাদের। এরপর এই দুজনের ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে গত ৭ মে ফের রিট আবেদন করেন তাদের স্বজনেরা। যদিও উত্থাপিত হয়নি মর্মে পরবর্তীতে সেই আবেদনও খারিজ করে দেন বিচারপতি মো. জাফর আহমেদ ও মো. বশির উল্ল্যার হাইকোর্ট বেঞ্চ। হাইকোর্ট রিট আবেদনটি করেছিলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের স্ত্রী ইসরাত রহমান এবং ফাঁসির দণ্ড পাওয়া জাহাঙ্গীর আলমের ভাই মিজানুর রহমান।

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, সর্বোচ্চ আদালতে এই দুজনের ফাঁসির দণ্ড বহাল থাকা সংক্রান্ত নথিপত্র রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আসার পরপরই কারাবিধি অনুযায়ী এই আসামির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তারা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে চান কি না। এরপর তারা এই ঘটনায় নিজেদের দোষ স্বীকার প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন। পরে তা নিয়ম মেনে কারা অধিদপ্তরের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েও দেওয়া হয়। সোমবার রাষ্ট্রপতি তাদের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করলেন।

জানা গেছে, ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হন অধ্যাপক তাহের আহমেদ। বাসাটিতে তিনি একাই থাকতেন। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম তার দেখাশোনা করতেন। ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বাসাটির পেছনের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় অধ্যাপক এস তাহের আহমেদের গলিত মরদেহ। ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।

এদিকে পুলিশ অধ্যাপক তাহেরের করা একটি জিডির সূত্র ধরে বিভাগের শিক্ষক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করেন পুলিশ। এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি মামলায় গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তিন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

জবানবন্দিতে তারা বলেন, অধ্যাপক তাহের বিভাগের একাডেমিক কমিটির প্রধান ছিলেন। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমিটির সুপারিশ চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু বাস্তব কারণে অধ্যাপক তাহের তা দিতে অস্বীকার করেন। মূলত পদোন্নতি না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মিয়া মহিউদ্দিন হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন।
তিন আসামি জবানবন্দিতে আরও বলেন, বালিশ চাপায় খুনের পর বাড়ির ভেতরে থাকা চটের বস্তায় ভরে অধ্যাপক তাহেরের লাশ বাসার পেছনে নেওয়া হয়। লাশ গুমের জন্য জাহাঙ্গীর আলম তার ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুলের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালামকে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ডাশমারি গ্রাম থেকে ডেকে আনেন। তাদের সহায়তায় বাসার পেছনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে অধ্যাপক তাহেরের লাশ ফেলে দেওয়া হয়।

২০০৭ সালের ১৭ মার্চ শিবির নেতা মাহবুব আলম সালেহীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেন পুলিশ। এ হত্যা মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দুজনকে খালাস দেন। দণ্ডিতরা হলেন- বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, অধ্যাপক ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, তার ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালাম। তবে বিচারে খালাস পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সি।

পরবর্তী দণ্ডপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিল বিভাগ মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের রায় বহাল রাখলেও আসামি নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালামের রায় কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন। তবে আপিলে সাজা কমে যাবজ্জীবন হওয়া দুই আসামির দণ্ড বৃদ্ধি চেয়ে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায়ই বহাল রাখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *