‘প্রতিকার পায় না ভুক্তভোগী, তার আগেই টেবিলের নিচে সমঝোতা হয়ে যায়’

Slider বিচিত্র


আড়াই বছর আগে সিজারিয়ান অপারেশন করাতে গিয়ে আলী হোসেনের স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এটি তার ছদ্ম নাম। আলী হোসেন বলছেন, অপারেশনের আগে অ্যানেস্থেসিয়া ইনজেকশন দেয়ার পর পরই মারা যান তার স্ত্রী। কিন্তু সেটি তাকে না জানিয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক এবং নার্স।

আলী হোসেন বলছিলেন, ‘আমাকে বলল যে, রোগীকে বাইরে নিতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসি। কিন্তু স্ত্রীকে যখন বের আনে ততক্ষণে সে মারা গেছে। মানে কাঁটা-ছেড়া করার আগেই মারা গেছে। পেটে বাচ্চা আছে। কিন্তু রোগী ফেলে রেখে ডাক্তার, নার্স চলে গেছে।’

সেই ঘটনার প্রতিকার পেতে আলী হোসেন থানায় একটি মামলা করেছিলেন। কিন্তু এরপরই শুরু হয় মামলা প্রত্যাহারের জন্য এবং সমঝোতায় আসার চাপ।

তার দাবি এক বছরের মধ্যেই প্রভাবশালীদের চাপে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে আপোসে রাজি হন তিনি। তাকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় সাড়ে তিন লাখ টাকা। বিনিময়ে সরে যান মামলার কার্যক্রম থেকে।

‘আমার পাশে কেউ ছিল না। এলাকার মাতবর, হাসপাতাল-ডাক্তারের লোক সবাই চাপ দিচ্ছিল। আমার মতো গরিব, অশিক্ষিত মানুষের পক্ষে মামলা চালানোও সম্ভব ছিল না। তাই আমি শেষ পর্যন্ত আপোস করে ফেলি।’

আলী হোসেনের এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো উদাহারণ নয়। বাংলাদেশে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়। কোনো কোনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা কিংবা সেবার নামে প্রতারণার অভিযোগ কখনো কখনো বেশ আলোড়নও তোলে।

আলী হোসেনের মত এরকম অনেক ঘটনা আছে বাংলাদেশে। প্রায় সময় হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর পর।

অভিযোগ আছে, হাসপাতালে অবহেলাজনিত মৃত্যু কিংবা অনিয়মের ঘটনায় আইনের ফাঁক-ফোকর গলে কিংবা প্রভাব খাটিয়ে সহজেই পার পেয়ে যায় অভিযুক্তরা। কিন্তু একটি হাসপাতাল যথাযথভাবে রোগীর চিকিৎসা দেয়ার উপযোগী কি-না, সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগ কেন সেটা নজরদারি করে নিশ্চিত করতে পারে না? এবং সেখানে ভুক্তভোগীরা কতটা প্রতিকার পেয়ে থাকেন?

তদারকি কতটা আছে?
ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর ঘটনা পর হাসপাতালটি পরিদর্শন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। পরিদর্শনে আইসিইউ’র মান সন্তোষজনক নয় বলে মত দেয় সংস্থাটি। বন্ধ করে দেয়া হয় অপারেশন থিয়েটারের সকল কার্যক্রম।

এমনকি ওই হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট একজন চিকিৎসকের চিকিৎসা কার্যক্রমও স্থগিত করে অধিদফতর।

কিন্তু হাসপাতালগুলোর কার্যক্রম বা মান ঠিক আছে কি-না, সে বিষয়ে সংস্থাটি কেন আগে থেকে ব্যবস্থা নিতে পারে না?

স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপপরিচালক (হাসপাতাল) শেখ দাউদ আদনান অবশ্য বলছেন, প্রতিনিয়ত হাসপাতালগুলো পরিদর্শন করে তদারকি করা স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষে সম্ভব নয়।

’আমাদের রেগুলার মনিটরিং করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা লাইসেন্স দেয়ার সময় যেটা করি, মনে করি যে বছরে একবার তো মনিটর করলাম। কিন্তু প্রতি ছয় মাসে একবার পরিদর্শন করা বা প্রতি মাসে করা এটা অনেক কঠিন একটা কাজ।’

দাউদ আদনান বলছেন, ১৪ হাজারের বেশি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে তদারকির আওতায় আনতে হলে সারাবছর প্রতিদিন কাজ করলেও সম্ভব হবে না। কারণ জনবল খুবই কম।

তাহলে রোগীদের স্বার্থ এবং চিকিৎসার মান কে দেখবে? তিনি বলছেন, এক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে।

‘কিছু জিনিস তো মানুষের নৈতিকতার ওপরও রাখতে হবে। এখানে যে বিশেষজ্ঞের নাম দিয়ে, যে স্টান্ডার্ড ঠিক করে তারা কার্যক্রম শুরু করেন, সেভাবে মেইনটেইন করা তো তাদেরও দায়িত্ব।’

ভূক্তভোগীরা ব্যবস্থা নিতে পারে?
বাংলাদেশে হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে আইন অনুযায়ী সেটা প্রতিকারের তিনটি ব্যবস্থা আছে। অভিযোগ যদি চিকিৎসকের বিরুদ্ধে হয়, তাহলে সেটা দেখবে বিএমডিসি।

অর্থাৎ রোগীর মৃত্যু বা যে সমস্যা হয়েছে সেটি চিকিৎসকের অবহেলার কারণে হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে তদন্ত এবং দায় নিরূপণ করবে সংস্থাটি।

আর হাসপাতাল কেন্দ্রীক অভিযোগ যেমন চিকিৎসার ব্যবস্থা বা অবকাঠামো যথাযথ ছিল কি-না এমন অভিযোগের সুরাহা করবে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

দু’টি ক্ষেত্রেই অভিযোগ প্রমাণিত হলে চূড়ান্ত প্রতিকার হচ্ছে, চিকিৎসকের কিংবা হাসপাতালের সনদ বাতিল পর্যন্ত।

এর বাইরে প্রতিকার বা শাস্তি চাইলে সেটা যাবে আদালতে। যেখানে জেল-জরিমানার বিধান আছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে অনেকেই সেই আইনি পথে যেতে চান না।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রশীদ-ই-মাহবুব বলছেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থাটাই ঠিকমত গড়ে ওঠেনি। রোগী যদি সংক্ষুব্ধ হয় বা সেবায় অবহেলার ঘটনা ঘটে সে চলে যায় পুলিশের কাছে। ক্রিমিনাল কেস হয়।

কিন্তু ডাক্তার তো হত্যার উদ্দেশ্যে চিকিৎসা করে না। সুতরাং এটা হচ্ছে, অবহেলাজনিত মৃত্যুর ঘটনা। কিন্তু আমাদের দেশে এই দু’টি বিষয় গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে ক্রিমিনাল কোর্টে মামলা যদি উঠেও সেটা হয় অনেক ধীরগতির।

‘এখানে বিচারালয়ে প্রতিকারটা পায় না ভুক্তভোগী। কারণ তার আগেই টেবিলের নিচে সমঝোতা হয়ে যায় ভূক্তভোগীদের সঙ্গে।’

রশীদ-ই-মাহবুব বলছেন, হাসপাতালে কোনো অনিয়ম পেলে স্বাস্থ্য অধিদফতর লাইসেন্স বাতিল বা লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত রাখতে পারে। এমনকি হাসপাতালটি বন্ধও করে দিতে পারে। কিন্তু দেখা যায়, এগুলো খুব একটা কাজে দেয় না। হয়ত ভিন্ন নামে, ভিন্ন মালিকানায় হাসপাতালটি আবারো চালু হয়ে যায়। স্বাস্থ্য বিভাগ এটা ঠেকাতে পারে না।

কিন্তু কেন? জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপপরিচালক (হাসপাতাল) শেখ দাউদ আদনান বলছেন আইনী সীমাবদ্ধতার কথা।

‘ধরেন আমি অনিয়ম পেয়ে কোনো হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল করে দিলাম। উনি পরের দিন একটা ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে পাশের বাসায় হাসপাতাল খুলে কার্যক্রম শুরু করে দিতে পারে। আইনগতভাবে আমরা এটা নিষেধ করতে পারি না। কারণ এটা তার নাগরিক অধিকার। আইনি কাঠামো আমাদের যতটুকু ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ দিয়েছে, আমরা তার বাইরে কিছু করতে পারি না।’

একদিকে চিকিৎসা সেবা নিয়ে নানারকম অভিযোগ অন্যদিকে আইন লঙ্ঘন করেও পার পেয়ে যাওয়া- সবমিলিয়ে ভূক্তভোগী রোগীদের প্রতিকার পাওয়ার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে খুবই কম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থের বিনিময়ে সমঝোতার চাপ। ফলে অনেক সময়ই ভুক্তভোগীরা আর আইনি প্রতিকারের দিকে এগুতে চান না।

সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *