ডলার বিক্রিতে রেকর্ড

Slider জাতীয়


বৈদেশিক মুদ্রায় আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় কাটছে না ডলার সংকট। এই সংকট সামাল দিতে প্রায় প্রতিদিনই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকালও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এই নিয়ে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত (১ জুলাই থেকে ১২ জুন) ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের (১৩ বিলিয়ন) বেশি বাজারে বিক্রি করা হয়েছে, যা এক অর্থবছরের হিসাবেও অতীতের যে কোনো সময়ের বেশি।

তবে গত জানুয়ারির পর থেকে ডলার বিক্রির গতি কিছুটা কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির রেট বাড়িয়ে ১০৬ টাকা করা হয়েছে। মূলত রিজার্ভ রক্ষায় এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রধানত প্রবাসী আয়ে নিম্নমুখী প্রবণতা, আগে নেওয়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ, আশানুরূপ নতুন ঋণ না পাওয়া এবং বিদেশি বিনিয়োগ কম আসায় ডলার সংকট কাটছে না। তাই নিয়মিত রিজার্ভ থেকে প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য ডলার সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে ক্রমশ চাপে পড়ছে রিজার্ভ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। ডলারের এ সংকট কাটাতে উচ্চাভিলাষী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও ডলার সংকট কাটছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে নতুন এলসি খোলা ও আমদানি দায়

পরিশোধ দুই-ই কমছে। সেই সঙ্গে রপ্তানি আয়ে বেশ গতি এসেছে। তবে প্রবাসী আয়ে ধীরগতি এখনো কাটেনি। অন্যদিকে উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের ছাড় কমে গেছে। নতুন ঋণও সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। আশানুরূপভাবে বাড়ছে না বিদেশি বিনিয়োগও। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি, চলতি হিসাবের ঘাটতি ও আর্থিক হিসাবে ঘাটতি পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হচ্ছে না। আর এ সবকিছুর মূলে রয়েছে ডলার সংকট। এ সংকট মোকাবিলায় প্রতিদিনই রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাস ১২ দিনে মোট বিক্রি করা হয়েছে ১ হাজার ৩০৬ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। এর মধ্যে জুলাইতে ১১৩ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, আগস্টে ১৩৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে ১০৬ কোটি ৮৯ লাখ ডলার, অক্টোবরে ১৪১ কোটি ডলার, নভেম্বরে ১৩৯ কোটি ৩৫ লাখ ডলার, ডিসেম্বরে ১৪৩ কোটি ২৮ লাখ ডলার, জানুয়ারিতে ১২২ কোটি ১৮ লাখ ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ৯২ কোটি ৪২ লাখ ডলার, মার্চে ৯৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, এপ্রিলে ৮৫ কোটি ডলার ও মে-তে ৯০ কোটি ৯৫ লাখ ডলার এবং জুন মাসের প্রথম ছয় দিনে ৩৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তার আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে কোনো ডলার বিক্রি দূরে থাক, উল্টো বাজার থেকে ৭৯৩ কোটি ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, বাজারে এখনো ডলারের ঘাটতি রয়ে গেছে। ডলারের চাহিদা যতটা, সরবরাহ তার তুলনায় কম। তাই প্রতিদিন ডলার বিক্রি করে জোগান দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আপাতত আর কোনো বিকল্প হাতে নেই।

বৈদেশিক মুদ্রায় আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বিদেশের সঙ্গে লেনদেনে ঘাটতি বাড়ছে বাংলাদেশের। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সার্বিক ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৪০ কোটি ডলার। এই ঘাটতির পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৬৬ শতাংশ এবং আগের মাসের চেয়ে প্রায় ৩ শতাংশ বেশি। এই ঘাটতিই অর্থনীতির জন্য এখন বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এর ফলে রিজার্ভেরও ধারাবাহিক পতন হচ্ছে। গত বুধবার দিনশেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। যা এক বছর আগেও ছিল ৪১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। ফলে গত এক বছরে রিজার্ভের পরিমাণ কমেছে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার।

ডলারের সংকট মোকাবিলায় শুরুতে এর দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। এরপর গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। তখন এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনকে (বাফেদা)। এরপর থেকে কয়েক দফা রেমিট্যান্স ও রপ্তােিত ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে আমদানিতে ডলারের দামও ক্রমশ বাড়ছে।

সর্বশেষ গত ৩১ মে এই দুই সংগঠন মিলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম আবারও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে, যা ১ জুন থেকে কার্যকর। ওই ঘোষণা অনুযায়ী, এখন থেকে রপ্তানিকারকরা রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম পাচ্ছেন ১০৭ টাকা, আগে যা ছিল ১০৬ টাকা। আর প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। আগে এ দাম ছিল ১০৮ টাকা। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দাম পড়বে সর্বোচ্চ ১০৮-১০৯ টাকা। তবে এই দামে ব্যাংকে ডলার মিলছে না বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। গতকাল আন্তঃব্যাংকে ডলার বিক্রি হয়েছে ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *