রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ঘাটতি

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


সরকারের রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দশ মাসে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি হয়েছে ৩৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আভাস দিয়েছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। সংস্থাটির দাবি, প্রতিবছর কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তার ব্যতিক্রম হয়নি এবারের বাজেটেও। চলতি অর্থবছর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা; কিন্তু অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক নানা কারণে রাজস্ব আদায়ের গতি স্বস্তিদায়ক নয়। বর্তমান অবস্থা বহাল থাকলে বছর শেষে সেই লক্ষ্যমাত্রায় ঘাটতি দাঁড়াবে ৭৫ হাজার কোটি টাকা।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের অর্থনীতিতে চলমান নানা অব্যবস্থাপনার কারণেই রাজস্ব আদায়ে এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। একই কারণে সার্বিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচকেরও অবনমন হয়েছে। এর জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ একটি কারণ হলেও এটিকে অজুহাত করার সুযোগ নেই। বরং কোথায় কীভাবে অব্যবস্থাপনা চেপে বসেছে, সেদিকে নজর রাখা জরুরি। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নীতিমালা, সুশাসন, প্রয়োজনীয় সংস্কার না করার কারণে যে দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটিই মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরের প্রতিঘাত এখন বড় বিবেচ্য বিষয়; কিন্তু মূল নিয়ামক নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সংস্কার করতে হবে। সেটি করতে গেলে সরকারকে বেশ কিছু শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচনের আগের বছর সেটি নেওয়া কতটা সম্ভব হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আসছে বাজেটে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প কিছু নেই।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। চলতি অর্থবছর রাজস্ব আহরণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা কম হতে পারে।

এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে যদিও তা ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কাস্টমস থেকে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ১১ হাজার কোটি, স্থানীয় পর্যায়ে

মূসক (ভ্যাট) থেকে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের দশ মাসে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৩৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। আগের বছরে একই সময়ে রাজস্ব আহরিত হয়েছিল ২ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে প্রথম দশ মাসে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ।

জানা গেছে, দশ মাসে আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চিল ৯৩ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আহরিত হয়েছে ৭৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ দশ মাসে শুল্ক আদায় কম হয়েছে ১৯ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। দশ মাসে মূসক আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৯৮ হাজার ১৪ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা থেকে মূসক আদায় কম হয়েছে ১০ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। আর আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৩ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭৮ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয়কর আদায় কম হয়েছে ৫ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হলো রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। সে জন্য আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের স্বাভাবিক প্রবণতার বাইরে জিডিপির অতিরিক্ত দশমিক ৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাস্তব চিত্র ভিন্ন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি বরং খারাপ হচ্ছে। বিশেষ করে শুল্ক ও আয়কর খাতে লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ আমাদের সময়কে বলেন, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব। ব্যয়ের বাজেট বড় হচ্ছে, কিন্তু আয় বাড়ছে না। ফলে ঘাটতি বাড়ছে। আসলে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা এনবিআরের সক্ষমতা অনুসারে হওয়া উচিত। অস্বাভাবিক লক্ষ্যমাত্রার ফলে সরকারের ঋণ বাড়ছে, চাপ বাড়ছে এনবিআরের ওপর।

অন্যদিকে আইএমএফের যেসব শর্তপূরণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এনবিআরকে, সেসব শর্ত এসেছে গত জানুয়ারির শেষের দিকে; বাংলাদেশের জন্য অনুমোদন করা ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের ‘বিনিময়ে’। অন্যান্য খাতের পাশাপাশি এনবিআরের জন্য সময় ধরে শর্ত দেওয়া হয়েছে। এসব শর্তের একটি আগামী অর্থবছরে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির অতিরিক্ত শুল্ক-কর আদায় করতে হবে। অতিরিক্ত শুল্ক-কর হতে হবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫০ শতাংশ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমান রাজস্ব প্রশাসন দিয়ে এত বড় লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। সংস্কারের বিকল্প নেই। যদিও গত ১৫-২০ বছরে এনবিআরে অনেক সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সম্ভব হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *