আলোর বন্যায় দূরীভূত করনের প্রত্যয়ে অনুষ্ঠিত দীপাবলী উৎসব

Slider গ্রাম বাংলা

14877830_331612693861836_1308263407_n

 

প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস প্রান্ত :পৃথিবীর প্রাচীন ধর্মগুলোর মধ্য সর্বধর্মের প্রসূতি স্বরূপ সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রাণের উৎসব দীপাবলী। উৎসবের নান্দনিকতার মত এর নামের নান্দনিকতা কম নয়। দীপাবলী তাঁর স্বমহিমায় দেওয়ালি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত হয়ে আসছে আমাদের সামাজিক পরিমন্ডলে। ধর্মশাস্ত্র মতে মহালয়ায় শ্রাদ্ধ গ্রহণের জন্য যম লোক ছেড়ে যে পিতৃপুরুষগণ মর্ত্যে আগমন করেন, তাঁদের পথ প্রদর্শনার্থে উল্কা জ্বালানো হয়। এ কারণে ঐ দিন আলোকসজ্জা ও আতশ বাজি পুড়িয়ে উৎসবের চিরাচরিত নিয়মের মূল্যায়ন করা হয়। মহাসমারোহে দিনটিকে বরণ করতে কেউ কেউ রাত্রিতে নিজগৃহের দরজা-জানালায় মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে; কেউ বা লম্বা বাঁশের মাথায় কাগজের তৈরি ছোট ঘরে প্রদীপ জ্বালায়; বাঁশের মাথায় প্রদীপ জ্বালানোকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় আকাশপ্রদীপ। প্রকৃতপক্ষে দীপাবলি মানে আলোর উৎসব। প্রতি বছরই দুর্গাপূজার আনন্দ-উচ্ছ্বাস মিইয়ে যাবার প্রাক্কালে দীপাবলি সূচিত হয়। বিজয়ার ভাসানে- পাঁচদিনের আনন্দ-বিদায়ে অবচেতনে হলেও যে বিয়োগ-বিধুর চেতনায় আবিষ্ট হয় মন। আর সেই মন দীপাবলিকে সামনে রেখেই নতুন আনন্দের স্বপ্নের দোলায় আবারও সুখ আন্দোলিত করে তোলে।দীপাবলী শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব নয়, এটি শিখ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদেরও প্রাণের উৎসব।বর্তমানে দীপাবলী অনুষ্ঠান সার্বজনীন উৎসবে পরিনত হয়েছে ; গ্লোবালাইজড সমাজে এখন একে আর সীমাবদ্ধ রাখা যাচ্ছেনা; এই অনুষ্ঠান আমার- আপনার- সবার; এদেশের- ওদেশের- সব দেশের; এ জাতির- সে জাতির- সব জাতির আনন্দ বিনোদনের বিষয় হয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে দীপাবলীর দিনে কালী পূজা হয়। তাই দীপাবলী আর কালী পূজার অনুষ্ঠান একসাথে গাঁথা। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, নেপাল, গুয়ানা, ত্রিনিদাদ-টোবাগো, মরিশাস, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ফিজি এবং সুরিনামে দীপাবলীতে সরকারী ছুটি হিসেবেই ঘোষনা করা হয়েছ অনেক আগে থেকে। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে দীপাবলীতে কালী পূজা হলেও অন্যান্য অঞ্চলে এই দিনে গণেশ পূজা এবং লক্ষ্মী পূজাও হয়ে থাকে । সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কেউ কেউ দীপাবলী দিনকে বিষ্ণু দেব এবং লক্ষ্মীদেবীর বিবাহ বার্ষিকী হিসেবে পালন করেন। জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর ৫২৭ অব্দে দীপাবলি দিনে মোক্ষ (নির্বাণ) লাভ করেন। দীপাবলি দিনে শিখ ধর্মগুরু গুরু হরগোবিন্দ জী অমৃতসরে ফিরে আসেন; সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করে গোয়ালিওর দুর্গ থেকে বায়ান্ন হিন্দু রাজাকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন।তাঁর এই বীরত্ত্বপূর্ন প্রত্যাবর্তনকে শিখগণ উৎসব হিসেবে পালন করেন; এই দিনকে তারা ‘বন্দী ছোড় দিবস’ ও বলে থাকেন।রামায়ণ অনুসারে দীপাবলির দিনে ত্রেতা যুগে শ্রী রাম চন্দ্র রাবণকে বধ করে চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। ভগবান শ্রী রাম চন্দ্রের চৌদ্দ বছর বনবাসের পরে এই প্রত্যাবর্তনে সারা রাজ্য জুড়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রজারা খুশীতে শব্দ বাজি করে। অনেকে মনে করেন দীপাবলির আলোকসজ্জা এবং শব্দ বাজি ত্রেতাযুগে রাম-রাজ্যে ঘটে যাওয়া সেই অধ্যায়কে সামনে রেখেই অন্যসব অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছে, পরিচিত হয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে।দীপাবলি মূলত পাঁচদিন ব্যাপী উৎসব। দীপাবলির আগের দিনের চতুর্দশীকে (এই দিনকে দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিন বলা হয়) বলা হয় ‘নরকা চতুর্দশী’; এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর স্ত্রী সত্যভামা নরকাসুরকে বধ করেছিলেন। চতুর্দশী পরের অমাবস্যা তিথি দীপাবলি উৎসবের দ্বিতীয় দিন, কিন্তু এই দিনই মূল হিসেবে উদযাপিত হয়। এই দিন রাতে শাক্ত ধর্মের অনুসারীগণ শক্তি দেবী কালীর পূজা করেন। তাছাড়া এই দিনে লক্ষ্মীপূজাও করা হয়, কথিত আছে এই দিনে ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী বরদাত্রী রূপে ভক্তের মনের কামনা বাসনা পূর্ণ করেন। বিষ্ণুপুরান মতে, বিষ্ণুর বামন অবতার অসুর বলিকে পাতালে পাঠান; দীপাবলি দিনে পৃথিবীতে এসে অন্ধকার ও অজ্ঞতা বিদূরিত করতে, ভালবাসা ও জ্ঞানের শিখা প্রজ্বলিত করতে অসুর বলিকে পৃথিবীতে এসে অযুদ অযুদ প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। দীপাবলির তৃতীয় দিন- কার্তিকা শুদ্ধ; এই দিন অসুর বলি নরক থেকে বেরিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে বিষ্ণুর বরে পৃথিবী শাসন করে।চতুর্থ দিন হচ্ছে ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া; একে যম দ্বিতীয়াও বলা হয়; এই দিন বোনেরা ভাইকে নিমন্ত্রণ করে, কপালে ফোটা দেয়, হাতে রাখী বেঁধে দেয়। পঞ্চম দিন সমাপনী উৎসবের মাধ্যমেই শেষ হয়ে ভক্ত হৃদয়কে পরিপূর্নতা দিয়ে যায়। প্রত্যেক সার্বজনীন আনন্দের উৎসব মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর জয়কেই উদযাপন করে। আলোকসজ্জার এই দিবস অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো জ্বালার দিন। নিজের ভেতরের বাহিরের সকল অজ্ঞতা ও তমঃকে দীপ শিখায় বিদূরিত করার দিন। প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার চিরন্তন শিখা প্রজ্বলিত করার দিন। দেশ থেকে দেশে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে- এই দিনের মাহাত্ম্য ভিন্ন ভিন্ন; তবু মূল কথা এক। আর আধ্যাত্মিকতার গভীর দর্শনে এই দিন- আত্মাকে প্রজ্বলিত করে পরিশুদ্ধ করে সেই পরমব্রহ্মে লীন হওয়ার দিন।দীপাবলি তাই আমাদের প্রাণের উৎসব, পরম প্রাপ্তির উৎসব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *