গাজীপুরে নিজের পায়ে কুঁড়াল মেরেছে আওয়ামীলীগ!

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


গাজীপুর: গোপালঞ্জখ্যাত গাজীপুরে নৌকার পরাজয় হল। একজন অরাজনৈতিক ঘরে থাকা নারীর কাছে পরাজিত হলেন প্রবীন আওয়ামীলীগ নেতা ও সাবেক টঙ্গী পৌরসভার ১৮বছরের চেয়ারম্যান ও মেয়র। পরাজিত প্রার্থী গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতিও। কেন এই পরাজয় তা অনুসন্ধান করে বেরিয়ে আসছে নানা তথ্য। সব তথ্য বিশ্লেষন করলে আওয়ামীলীগ নিজের পায়ে নিজেই কুঁড়াল দিয়েছে বলে প্রতিক্রিয়া আওয়ামীলীগের ত্যাগী কর্মীদের।

আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতা কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৩ সালে তৎকালিন বিএনপির মেয়র প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নানের কাছেও হেরে যায় আজমত উল্লাহ খান। ওই নির্বাচনে আনারস প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন জাহাঙ্গীর আলম। ২০১৩ সালের নির্বাচনে প্রচারণা শুরু দিনই জাহাঙ্গীর আলমকে টঙ্গী থেকে নিয়ে যায় আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতা। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দলীয় প্রধানের কাছে। প্রতীক রেখেই নৌকায় তোলা হয় জাহাঙ্গীর আলমকে। জাহাঙ্গীর আলম কাঁদতে কাঁদতে নিজের প্রতীক আনারস রেখে নৌকার ভোট চেয়েছিলেন তখন। সেই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর নিজে নৌকার নির্বাচন করলেও তার প্রতীক আনারস ৫হাজার ভোট পায়। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচনেই শুরু হয় দলীয় কোন্দল। জাহাঙ্গীর বনাম আজমত উল্লাহর মধ্যে ২০১৩ সালে শুরু হওয়া দ্বন্ধ আজ প্রকাশ্যে এমন ভাবে রুপ নিল যে গাজীপুরে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকার পরও নৌকা প্রতীক হেরে গেলো। ২০১৩ সালে সৃষ্টি হওয়া কোন্দল ১০ বছর পরও বিকট শব্দে কাঁপিয়ে দিল গাজীপুর সহ দেশ-বিদেশ। গাজীপুরের নির্বাচন সুষ্ঠু করতে জাহাঙ্গীর আলম বিদেশী দূতাবাসেও চিঠি দিতে বাধ্য হয়। কারণ ফল বিকৃতির আশংকা থেকে তার এই ধারণা বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীর পন্থীরা।

অনুসন্ধান বলছে, ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীর আলম যখন নৌকা পেলেন তখন আজমত উল্লাহ খান জাহাঙ্গীরের পক্ষে মাঠে নির্বাচন করেছেন। বিজয়ী হওয়ার পর জাহাঙ্গীর আলম ও আজমত উল্লাহ খান এক সাথে বসে মিষ্টিও খেয়েছেন। আজমত-জাহাঙ্গীরের এক সাথে পথচলা হলেও তাদের অনুসারীদের মধ্যে মিল হয়নি। গাজীপুর মহানগরের পূর্নাঙ্গ কমিটি গঠনের সময়ও দুই পন্থীদের আধিক্য ছিল। কে কার পন্থী তা নিয়েও বিভেদ ছিল। এসব জেনেও আজমত -জাহাঙ্গীর বা আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্ধ তৃনমূল থেকে আজমত জাহাঙ্গীর কোন্দলের অবসান করেননি। জেনেও না জানার ভ্যান করা সিনিয়র নেতারা হয়ত চেয়েছিলেন দ্বন্ধ ভেতরে থাকলে ক্ষতি নেই। নেতা ও কর্মীদের মধ্যে দূরত্বও তৈরী হয়েছে আজমত-জাহাঙ্গীর এক সাথে চলার সময়ও। গাজীপুর মহানগর কমিটি গঠন ও মেয়র পদ পরিচালনা করার সময়ও আজমত-জাহাঙ্গীর পন্থীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ছিল। জাহাঙ্গীর আলমের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর
আজমত-জাহাঙ্গীরের দৃশ্যমান মিল ভেঙে যায়। আওয়ামীলীগ দলীয়ভাবে অডিওটি পরীক্ষা নীরিক্ষা না করে আন্দোলনে নেমে পড়ে। অডিওকে ঘিরে আজমতপন্থী কর্মীরা চেপে থাকা ক্ষোভ থেকে রাজপথে নেমে আসে অনেকটা নানা উস্কানীতে। সিনিয়র নেতবৃন্ধের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে জাহাঙ্গীরকে হঠাতে তারা অডিও নিয়ে রাজপথে জ্বালাও পোড়াও শুরু করে দেয়। এক পর্যায়ে কোন তদন্ত ছাড়াই আন্দোলনের চাপে জাহাঙ্গীরের দলীয় ও মেয়র পদ চলে যায়। এই ঘটনার পর আজমত ও জাহাঙ্গীর পন্থীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। একই দলের হলেও পরস্পর বিরোধী অবস্থানে চলে যায় দুই পন্থী নেতা-কর্মীরা। এতে দলীয় আভ্যন্তরীন কোন্দল প্রকাশ্যে শত্রুতায় রুপ নেয়। এই অবস্থায় বেশ কিছুদিন পর জাহাঙ্গীর আলমকে সাধারণ ক্ষমা করে দেয় আওয়ামীলীগ। কিন্তু এই ক্ষমার আগেই গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সম্মেলন হয়ে যায়। ফলে দলের প্রাথমিক সদস্য পদ ও সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে আজীবন বহিঃস্কার হওয়া জাহাঙ্গীর আলম ক্ষমা পেলেও পাননি কোন পদ। এতে জাহাঙ্গীর মানষিকভাবে ভেঙে পড়ার পর্যায়ে চলে যায়। মেয়র পদ ও দলীয় পদ হারিয়ে জাহাঙ্গীর আলম প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। উপায় না দেখে জাহাঙ্গীর আলম কান্না থামিয়ে শক্ত অবস্থান নেয়।

২০২৩ সালের ২৫মে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম প্রার্থী হলেও কৌশলে তার মাকেও প্রার্থী করেন। কারণ জাহাঙ্গীর আলম আঁচ করতে পেরেছিলেন তাকে বাদ; দেয়া হতে পারে। হলও তাই। জাহাঙ্গীর আলম বাদ গেলেন। রয়ে গেলেন তার মা। আর বিজয়ী হলেন জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। যে আজমত উল্লাহ খান রাজনীতিতে জাহাঙ্গীর আলমের কাছে হেরেছিলেন সেই আজমত উল্লাহ খান এবার জাহাঙ্গীরের মার কাছেও হারলেন। সৃষ্টি হল এক নতুন ইতিহাস। গোপালগঞ্জখ্যাত গাজীপুরে হেরে গেলো নৌকা। তাও আবার বিএনপি বা অন্য কোন প্রার্থীর কাছে নয় একজন ঘরে থাকা শান্তিপ্রিয় নারীর কাছে যিনি জীবনে কোন দিন রাজনীতি করেন নি প্রকাশ্যে।

২৫ মের নির্বাচন বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, এই নির্বাচনে ভোট গ্রহন শান্তিপূর্ণ হলেও আগের পরিবেশ ছিল ঘোমট। জাহাঙ্গীর আলমের মা ও তার কর্মীরা প্রকাশ্যে প্রচার প্রচারণা করতে পারেননি। পোষ্টার ও লিফলেটও প্রকাশ্যে বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি টেবিল ঘড়ির পোষ্টার বা লিফলেট সাথে থাকলে তাকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন হয়রানী করেছে কখনো বা গ্রেপ্তারও করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনের পূর্বে বিরোধী দল বিএনপি জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা ও হয়রানীও কাল হয়েছে আজমত উল্লাহর। জাহাঙ্গীরের মার গাড়ি বহরে একাধিক হামলার ঘটনাও টেবিল ঘড়িকে এগিয়ে দিয়েছে অনেক দূর। সাথে যুক্ত হয়েছে আওয়ামীলীগে থাকা জাহাঙ্গীর পন্থীদের বহিঃস্কার আর শোকজের এ্যাকশন।

আওয়ামীলীগের সাধারণ সমর্থকেরা বলছেন, আবেগ আর নির্যাতনে দলীয় ও সাধারণ ভোটাররা নৌকার প্রতি মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়েছিল। সাথে যুক্ত হয়েছে এজেন্টহওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলানো বা এজেন্ট বের করে দেয়ার ঘটনা। সব মিলিয়ে মানুষ নির্যাতিতের পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে গাজীপুরে নৌকার পরাজয় হয়েছে বলে অভিমত তাদের।

এ সকল বিষয়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ ,মন্ডল বলেছেন, নৌকার ব্যাজ পড়ে টেবিল ঘড়িতে ভোট দিয়েছে মানুষ। তাই এমন হয়েছে।

পরাজয় মেনে নিয়ে আজমত উল্লাহ খান বলেছেন, পরাজয়ের কারণ খুঁজে বের করা হবে। তবে নির্বাচনকে তিনি সুষ্ঠু ও অবাধ বলে উল্লেখ করে বিজয়ী মেয়রকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

সবশেষ জাহাঙ্গীরের মা নব নির্বাচিত গাসিক মেয়র জায়েদা খাতুনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *