জেলার পর ঢাকামুখী আন্দোলন গড়ার পরিকল্পনা বিএনপির

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


দেশের সব জেলা ও মহানগরে পর্যায়ক্রমে গণসমাবেশ কর্মসূচি শেষে ঢাকামুখী আন্দোলন গড়ার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। ঈদুল আজহা ও এসএসসি পরীক্ষা শুরুর বিষয়টি মাথায় রেখে নতুন করে কর্মসূচি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিভাগীয় গণসমাবেশের আদলে নতুন কর্মসূচি করার চিন্তা করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। আন্দোলনের পথরেখা চূড়ান্ত করতে গত মঙ্গলবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে নতুন কর্মসূচি বিষয়ে মতামত নেন।

এদিকে, গতকাল বুধবার বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এই বৈঠকের পর দলের নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী

আগামী ১৩ মে শনিবার বেলা ২টায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দফা দাবি আদায় এবং গায়েবি মামলায় নির্বিচারে গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা ও পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের উদ্যোগে এই সমাবেশ হবে। কর্মসূচি সফল করতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

তিনজন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবারের সমাবেশ থেকে সাংগঠনিক জেলাগুলোতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ‘১০ দফা দাবি আদায় এবং গায়েবি মামলা ও হাজিরা দিতে গিলে জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর প্রতিবাদে’ ২০ মে থেকে এই কর্মসূচি শুরু হবে। সেক্ষেত্রে দলের সাংগঠনিক ৮২ জেলায় একযোগে কর্মসূচি না করে ভাগ করে ধাপে ধাপে করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। চলমান আন্দোলন-কর্মসূচি সফল করতে বিরোধপূর্ণ ইউনিটের সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা নিরসন করতে বলেছে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।

বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নতুন কর্মসূচি ঠিক করার বিষয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদিও স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আগে গত মঙ্গলবার দুপুরে নতুন কর্মসূচির বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, আন্দোলন একটা ওয়েবের মতো। এটা কখনো উঠে, কখনো নামে। সেটা জনগণের সব পরিপ্রেক্ষিত বুঝে নিয়ে আমাদের আন্দোলনটা করতে হয়। এখন আমরা যারা আন্দোলনের অংশীদার আছি, যে শরিক দলগুলো আছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত আলোচনার পর্যায়ে এসেছি। খুব শিগগিরই নতুন করে কর্মসূচি জানতে পারবেন।
গত মঙ্গলবারের স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনের এই ধাপে জেলাপর্যায়ে নিয়মতান্ত্রিক গতানুগতিক কর্মসূচি দেওয়া হবে। এর পর চূড়ান্ত পর্যায়ে সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকায় এনে বড় ধরনের জমায়েত করার পরিকল্পনা করেছে দলটি।
বিএনপির ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, কর্মসূচি নির্ধারণ করতে মঙ্গলবার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কর্মসূচির একটি পথরেখা তৈরি করা হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলন কবে শুরু হবে তা ঠিক করেননি নীতিনির্ধারকরা।
বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দল এবং জোট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা-মহানগর পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ, গণসমাবেশ, গণঅবস্থানÑ এ ধরনের কর্মসূচির মতামত এসেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, জেলা-মহানগর পর্যায়ের কর্মসূচি শেষ করে ঢাকামুখী রোড মার্চ, লং মার্চ কিংবা ঢাকা ঘেরাওয়ের মতো বড় কর্মসূচিতে যাবে দলটি।
দলের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, প্রথম ধাপে আন্দোলনের গতি বাড়াতে কর্মসূচি দেওয়া হবে। জেলা পর্যায়ের ওই কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নিতে চায় দলটি। কর্মসূচির লক্ষ্য জনসম্পৃক্ততা এবং জনসমর্থন আদায় করা। এক্ষেত্রে সব জেলা ও মহানগরে পর্যায়ক্রমে সমাবেশের বিষয়ে মত এসেছে বেশি। গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিভাগীয় গণসমাবেশের আদলে এই কর্মসূচি করতে পারে বিএনপি।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা জেলা কিংবা বিভাগীয় পর্যায় থেকে রোড মার্চের ব্যাপারে প্রায় সবাই বিরোধিতা করেছেন। নেতারা বলেন, রোড মার্চ বিশাল রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ। খালেদা জিয়া ছাড়া এ ধরনের কর্মসূচি সফল করা সম্ভব নয়। অন্য নেতাদের নেতৃত্বে ঢাকা থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে যাওয়ার পথে মোড়ে মোড়ে নেতাকর্মীদের আনা কঠিন হবে। বৈঠকে একাধিক নেতা বলেন, সারাদেশে আবার ধড়পাকড় শুরু হয়েছে। গায়েবি মামলা দেওয়া হচ্ছে। নেতাকর্মীদের বাড়ি তল্লাশি এবং জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর ঘটনাও বাড়ছে। তাই নতুন কর্মসূচি দিয়ে দ্রুত মাঠে নামতে হবে। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলন কখন শুরু হবে, সে সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, জেলা পর্যায়ের কর্মসূচির মাধ্যমে চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলনে একটি ভিত্তি তৈরি হবে। সেই আন্দোলনের ধরন দেখে চূড়ান্ত কর্মসূচির দিনক্ষণ ঠিক করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন ছাড়াও যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে গণঅধিকার পরিষদের বেরিয়ে যাওয়া, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালনসহ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, রূপরেখা প্রণয়ন নিয়ে গণতন্ত্রের মঞ্চের চিন্তার সঙ্গে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা একমত হননি। এ নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া দরকার বলে মনে করেন নেতারা। ফলে যৌথ ঘোষণা কিছুদিন পিছিয়ে যেতে পারে।
জানা গেছে, বৈঠকে যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র হিসেবে গণতন্ত্র মঞ্চের দেওয়া ৩৫ দফা খসড়া রূপরেখা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। বিএনপির ১০ দফা দাবি ও রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা অটুট রেখে গণতন্ত্র মঞ্চের দাবিগুলো তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এতে গণতন্ত্র মঞ্চ সম্মত হলে তবে যৌথ ঘোষণা করা হবে। কোনোভাবেই ১০ দফা ও ২৭ দফা বাড়াতে রাজি নন নেতারা। কারণ, ১০ ও ২৭ দফার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সারাদেশের বিভাগীয় পর্যায়ে সেমিনারে এবং পুস্তিকা আকারে ঢাকাস্থ বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে বিতরণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জনমত গড়ে উঠেছে। এ অবস্থায় বিএনপির ১০ দফা দাবি ও রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফার পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া গণতন্ত্র মঞ্চের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবে দলটি।
লিয়াজোঁ কমিটির এক বিএনপি নেতা বলেন, সামনে তো আমরা এক দফার আন্দোলন শুরু করব। সেখানে ১০ দফা কোনো বিষয় নয়। আর রাষ্ট্র মেরামতের জন্য বিএনপির যে ২৭ দফা রয়েছে, সেখানে গণতন্ত্র মঞ্চের প্রস্তাবগুলো যুক্ত করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ২৭ দফার মূল কাঠামো ঠিক রাখা হবে। এ নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে বিএনপি।
এদিকে বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জোট গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে গণঅধিকার পরিষদের বের হওয়ার বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলে মনে করছেন নেতারা। এতে আন্দোলনে প্রভাব পড়বে না। স্থায়ী কমিটির সভায় মির্জা ফখরুল বলেছেন, গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের মনোমালিন্যে এটি হয়েছে। কিন্তু তারা যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকবে।
আগামী ৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। কর্মসূচি ঠিক করতে গত মঙ্গলবার রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক করেছে। রাত সাড়ে ৮টা থেকে পৌনে ১২টা পর্যন্ত বৈঠক চলে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান আমাদের সময়কে বলেন, কর্মসূচি প্রায় চূড়ান্ত। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, এবার ব্যতিক্রম কিংবা শক্ত কর্মসূচি আসছে না। নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে থাকবেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *