রাষ্ট্রপতির পালাবদল জটিল সময়ের অভিভাবক

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


জনাব মো. আবদুল হামিদ গতকাল বেলা এগারোটার পর থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন। এ পর্যন্ত তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রপতি যিনি দুই মেয়াদ পূর্ণ করে সম্মানের সাথে অবসরে গেলেন এবং তার আগে অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার উত্তরসূরির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। বাংলাদেশে এর আগে রাষ্ট্রপতি পদে এক মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন নব্বই-উত্তর গণতান্ত্রিক সময়ের বিএনপির প্রথম সরকারের রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস।

তবে এবারে ক্ষমতায় নিজ দল থাকার ফলে জনাব হামিদের বিদায় সম্মান ও সৌন্দর্যের সাথে সম্পন্ন হয়েছে। এদেশে দুজন রাষ্ট্রপতি নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, তিনবার সংবিধান স্থগিত করে সেনা শাসন এসেছে দেশে। ফলে এবারের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মো. আবদুল হামিদের উত্তরসূরি মোঃ সাহাবুদ্দিন গতকাল থেকেই রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। আমরা আশা করব জনাব হামিদ এ পদের যে উচ্চ মান তৈরি করে দিয়েছেন নতুন রাষ্ট্রপতিও সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করবেন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ছাত্রজীবন থেকেই একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি প্রথম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই থেকে

রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত দেশের যেসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল তিনি তাতে বিজয়ী হয়েছেন। এলাকার জনপ্রিয় সন্তান দেশের শীর্ষপদে থেকে দল ও দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। তবে বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। তদুপরি একদিকে দলীয়প্রধানের ভূমিকা, ভাবমূর্তি ও ক্ষমতার বিচারে একজন দলীয় রাষ্ট্রপতির পক্ষে স্বতন্ত্র অবস্থান গ্রহণ কঠিন। তবু নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে তিনি অনেক সময় রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ কাজে তিনি আন্তরিক হলেও উদ্যোগ সফল করা ছিল কঠিন এবং তা হয়ওনি। অবশ্য জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক মহলও এ কাজে সফল হতে পারেনি। আমাদের দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলকে পরস্পরবিরোধী অবস্থান ঘুচিয়ে কাছাকাছি এনে জাতীয় সংকট নিরসন আদতেই একটি কঠিন কাজ।

নতুন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিগত দুটি নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহলও আসন্ন নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হোক তা জোরালোভাবেই চাইছে। তা ছাড়া এই সময়ে চীন এবং রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সম্পর্কে টানাপড়েন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধও খুব দ্রুত বন্ধ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এদিকে চীন-ভারত সীমান্ত সংকট তীব্রতর হওয়ায় এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব ভারতের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে চাইছে। বিশ্বরাজনীতির এই জটিল সমীকরণের মধ্যে এ অঞ্চলে ভূরাজনীতির প্রভাব ও টানাপড়েন বাড়বে। ফলে বাংলাদেশকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে নিজেদের ভূমিকা নির্ধারণ করতে হবে। এ সময়ে সরকারের জন্য একজন বিচক্ষণ রাষ্ট্রপতির সহায়ক ভূমিকা হবে মূল্যবান। বলা যায়, শুরু থেকেই নতুন রাষ্ট্রপতিকে অত্যন্ত সজাগ ও সতর্ক থেকে বিশ্বরাজনীতি অনুধাবন করে সরকারের পাশে থাকতে হবে।

তা ছাড়া ইতিহাসে নিজের ছাপ রাখতে চাইলে তাকে বাংলাদেশের রাজনীতির জটিল গ্রন্থিগুলো যেমন বুঝতে হবে তেমনি সরকার চাইলে সেসব জট খোলার কাজে অভিভাবকের ভূমিকা নিতে হবে। দেশীয় রাজনীতি ছাড়াও যুদ্ধ, রাজনীতির টানাপড়েন, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, নারী ও শিশু পাচার, মাদকের আন্তর্জাতিক কারবার, আন্তর্জাতিক জঙ্গি তৎপরতা ইত্যাদি নানা বিষয় মিলিয়ে বিশ্ব ও এর বাসিন্দারা আজ অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এর সাথে বাংলাদেশের গত দেড় দশকের উন্নয়নের গতি ধরে রাখার যে প্রয়াস তা-ও তার বিবেচনায় থাকতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এসবই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।

দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ বিশ্বের একটি ছোটখাটো দেশ হলেও তার জনবল, অর্থনীতির আকার ও প্রবৃদ্ধির গতি, শান্তি মিশনসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কার্যকর ভূমিকা, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি মিলিয়ে আমরা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিক্রম করছি। এই সময়ে দায়িত্ব পালনে এসেছেন নতুন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আমরা সময়ের সংকটময়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেব এবং সেই সাথে রাষ্ট্রপতি পদে থেকে দায়িত্ব পালনের যে সুযোগ তৈরি হচ্ছে তার কথাও বলব। আশা করি মহামান্য রাষ্ট্রপতি জাতি ও ইতিহাসের দায় পূরণে সচেষ্ট থাকবেন, সফল হবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *