ব্যবসায়ীদের ঈদস্বপ্ন ভস্মীভূত

Slider জাতীয়


এক বুক স্বপ্ন নিয়ে গত সোমবার রাতে ঘরে ফেরা যুবক কাউছার গতকাল ঘুম ভেঙে এসে দেখেন তার সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মা গার্মেন্ট নামে তার দুটি দোকানের একটি সুতাও অবশিষ্ট নেই। দুটি দোকানে এক কোটি টাকার পোশাক তুলেছিলেন তিনি। এর মধ্যে ৫০ লাখ টাকা এনেছিলেন ধারদেনা আর ব্যাংক লোন করে। করোনার কয়েক বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশায় তিনি বুক বেঁধেছিলেন আসন্ন ঈদকে ঘিরে। শুধু কাওছারই নন, বঙ্গবাজারে গতকাল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তার মতো প্রায় ৫ হাজার দোকানি পথে বসেছেন। অসহায় ব্যবসায়ীদের গুমোট কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে বঙ্গবাজার এলাকার পোড়া বাতাস।

গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৬টা ১০ মিনিটে ৯৯৯ থেকে আসা কলে দোকানিরা জানতে পারেন, বঙ্গবাজার আদর্শ মার্কেটে আগুন লেগেছে। কয়েকশ মিটার দূরেই ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর। আগুন লাগার পর সেখান থেকে আসা একাধিক ইউনিটের তৎপরতা শুরু হয়। পরে রাজধানীর বিভিন্ন ফায়ার স্টেশন থেকে একে একে ৪৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে অংশ নেয়। সাড়ে ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় দুপুর ১২টা ৩৪ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ১৯৯৫ সালে একবার ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় দেশে পাইকারি কাপড়ের সবচেয়ে বড় মার্কেট বঙ্গবাজার। এরপরও বঙ্গবাজারে আগুন লেগেছিল বিভিন্ন সময়ে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই আগুন লেগে মার্কেটের গুলিস্তান ইউনিটের কয়েকটি দোকান পুড়ে যায়।

জানা গেছে, বঙ্গবাজারে আগুন লাগার খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বিক খোঁজ-খবর রাখেন। সকালে একনেক সভার শুরুতেই এ অগ্নিকাণ্ডের কথা উঠে আসে আলোচনায়। দীর্ঘ আলোচনার একপর্যায়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী; বেশ কয়েকবার তিনি আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি এর সমাধানে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন।

এদিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দুই শতাধিক কর্মী মাঠে নামে। ঘটনাস্থলে ছুটে আসে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি। বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে পানি ছিটাতেও দেখা যায়। উৎসুক জনতার ভিড়, পানির সংকট ও বাতাসের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে, জানান ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।

‘কেয়ামতের মতো অবস্থা’

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, কেয়ামতের মতো অবস্থা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের চোখে এখন কান্না। তারা সব পুঁজি হারিয়েছেন। খুচরা ও পাইকারি কাপড়ের সাতটি মার্কেটে আগুন লেগে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যবসায় ফিরিয়ে আনতে ৭০০ কোটি টাকা প্রয়োজন, জানান তিনি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কাঠ আর টিনে গড়ে তোলা মার্কেটের টিন পুড়ে বাঁকা হয়ে গেছে; কাঠ পুড়ে হয়েছে কয়লা আর কাপড় পুড়ে হয়ে গেছে ছাই। আগুন নেভানোর পর পোড়া স্তূপ ঘাটতে দেখা গেছে দোকানিদের। স্তূপের ভেতর থেকে মাঝেমধ্যে অর্ধপোড়া কাপড় বেরিয়ে আসছে। এই পোড়া কাপড়ের দিকে তাকিয়ে চোখ ভিজে যাচ্ছিল তাদের। অর্ধপোড়া টাকাও বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে ছাইয়ের গাদা থেকে। পোড়া টাকা, পোড়া কাপড় বুকে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন কেউ কেউ।

কিছু ব্যবসায়ী গুদাম থেকে কিছু মালামাল বের করতে পেরেছেন। এমন ভাগ্যবানদের একজন জিএস করপোরেশন ও লেহেঙ্গা কালেকশনের কর্ণধার মো. স্বপন। গুদাম থেকে বের করা কাপড়ের গাঁইটের ওপর মলিন মুখে বসে থাকা স্বপন আমাদের সময়কে জানান, বঙ্গবাজারে তার দুটি দোকান। ঈদ সামনে রেখে প্রায় দুই কোটি টাকার মালামাল দোকানে তুলেছিলেন। আগুন লাগার খবর শুনে সকালে এসে এনেক্স ভবনের গুদাম থেকে কিছু মাল বের করতে পেরেছেন। তবে সেটা কয়েক লাখ টাকার মাত্র। আর সব মালামালই পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, আমি তো তাও কিছু মালামাল বের করতে পেরেছি। কিন্তু অধিকাংশ ব্যবসায়ী একটি সুতা পর্যন্ত বের করতে পারেননি, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

বঙ্গবাজারের দ্বিতীয় তলায় হামদান শাড়ির দোকান জাহেদুল ইসলাম বাবুলের। তিনি জানান, দোকানে ৫০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। ঈদবাজারে ঋণ করে দোকানে অতিরিক্ত মালামাল তুলেছিলেন। এখন আর কিছুই নেই। সব স্বপ্ন এখন ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে।

দোকানদারদের অনেকেই বলছেন, দোকান-মালামালের সঙ্গে তাদের রক্ষিত নগদ টাকাও পুড়ে গেছে। তারা জানান, ২৫ রোজা পর্যন্ত কেনাকাটার টাকা দোকানেই রাখেন। এ সময়ে পাইকার ও কারখানার মালিকের সঙ্গে প্রচুর টাকা লেনদেন করতে হয়। তদুপরি রাতে দোকান বন্ধ করে টাকা নিয়ে বাসায় যাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ। সব পুড়ে গেছে, পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেছেন তারা। মল্লিকা গার্মেন্টের মালিক নূর আলম জানান, তার ক্যাশ বাক্সে ৮ লাখ টাকা ছিল। মহাজনের টাকা পরিশোধ করতে হবে রেখেছিলেন দোকানে। সঙ্গে ৩০ লাখ টাকারও বেশি মালামাল ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

বঙ্গবাজারের দোকান মালিকরা বলছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন বঙ্গবাজার কয়েকটি ইউনিটে বিভক্ত। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট মিলিয়ে মোট দোকানের সংখ্যা ২ হাজার ৩৭০টি। আশপাশের বিপণিবিতান মিলিয়ে ৫ হাজারের মতো দোকান ভস্মীভূত হয়েছে গতকালের আগুনে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে পাশাপাশি মার্কেট রয়েছে চারটি। এগুলো হচ্ছে- আদর্শ হকার্স মার্কেট, বঙ্গ গুলিস্তান, এনেক্সকো মার্কেট ও মহানগর শপিং কমপ্লেক্স। বিশেষ করে বঙ্গ ও আদর্শ হকার্স মার্কেটের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এছাড়াও বিপরীত পাশে ইসলামিয়া মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্কেটের আশপাশের বিভিন্ন দোকান। এ মার্কেটের ঠিক পিছনে পূর্বপাশে পুলিশ সদর দপ্তর। মার্কেটের আগুন গিয়ে লাগে পুলিশ সদর দপ্তরের বাউন্ডারির ভেতরে ব্যারাক ভবনে। সেখানেও কম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। অগ্নিকা-ের পর সকালেই বন্ধ হয়ে যায় জাতীয় জরুরি সেবা সার্ভিস ৯৯৯।

সূত্রপাত আদর্শ মার্কেট থেকে

আগুনের সূত্রপাত আদর্শ মার্কেট থেকে। মার্কেটে দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুতই তা পাশের মার্কেটগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা।

‘রহস্যজনক’

গতকালের আগুন নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা তার কোনো সদুত্তর মেলেনি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই অগ্নিকা-কে বলছেন ‘রহস্যজনক’। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন।

এটা নাশকতা নয়, দুর্ঘটনা : ডিএসসিসি মেয়র

বঙ্গবাজারের এ অগ্নিকা-ের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, এটা দুর্ঘটনা, কোনো নাশকতা নয়। দুর্ঘটনা হওয়ায় এখানে কারও দায় নেই। সব সংস্থা একসঙ্গে কাজ করেছে বলেই এত বড় আগুন অল্প সময়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। তিনি আরও বলেন, আগুনের ঝুঁকি থাকার পরও কেন আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, সেটি খতিয়ে দেখা হবে।

মেয়র জানান, বঙ্গবাজার মার্কেটটি ২০১৯ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ডিএসসিসি। এরপর নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মার্কেট সমিতি নতুন ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে নতুন ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়নি।

মার্কেটটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ : ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি

??আগুন লাগা মার্কেটটিকে ২০১৯ সালে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল বলে জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল ভবনটিকে আমরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছি এবং ব্যানার টাঙিয়েছি। এরপর ১০ বার নোটিশ দিয়েছি। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব ছিল, আমরা করেছি।

ভয়াবহ এই অগ্নিকা-ের ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যসহ মোট ১২ জন আহত হয়েছেন। তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।

পুড়েছে পুলিশের ব্যারাক, ডিএমপির নিয়ন্ত্রণ কক্ষ

বঙ্গবাজারের আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে পাশের পুলিশ সদর দপ্তরেও। এতে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পুড়ে গেছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জাতীয় সেবার নম্বর ৯৯৯-এর সেবা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আগুন লাগার পর এ সেবা বন্ধ হয়ে যায়।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর পুলিশ মহাপরিদর্শক আল-মামুন সাংবাদিকদের জানান, পুলিশ সদর দপ্তরের পাঁচতলা ভবনে আগুন লেগে যেসব ক্ষতি হয়েছে, তা নিরুপণ করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, দমকল বাহিনীর পাশাপাশি র‌্যাবসহ পুলিশের একাধিক ইউনিটের প্রায় দুই হাজার সদস্য বঙ্গবাজারের আগুন নেভানোসহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছেন।

ঘটনাস্থলে আসা মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, শুধু মহানগর মার্কেটেই ৮০০ দোকান রয়েছে। যেগুলোর বেশিরভাগই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতি ‘খ ইউনিট’-এর সভাপতি মো. লোকমান খান বলেন, আমাদের এখানে প্রায় তিন হাজার দোকান। ঈদে প্রতিটি দোকানে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকার মাল থাকে। কোনো কোনো দোকানে ১০ কোটি টাকারও পুঁজি থাকে। আগুনে শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। দোকানদাররা ঋণ করে এই মৌসুমে মালামাল তুলেছিল। তাই তারা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেছে।

ফায়ার সার্ভিস দপ্তরে হামলা

বঙ্গবাজারে লাগা ভয়াবহ আগুন দ্রুত নেভানো সম্ভব না হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরে হামলা করেছে উত্তেজিত জনতা। এতে ফায়ার সার্ভিসের অন্তত চার কর্মী আহত হন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উত্তেজিত জনতা প্রথমে সদর দপ্তরে ঢিল ছুড়তে শুরু করে। একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণকক্ষে হামলা চালায়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক অভিযোগ করেন, হামলা চালিয়ে সদর দপ্তরের গাড়ি ও ভবন ভাঙচুর করা হয়েছে। তিনি বলেন, আপনাদের পাশে সবার আগে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা থাকেন। তারপরও আমার ওপর কেন আক্রমণ?

এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আগে এ বিষয়ে তদন্ত করা হবে। পরে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *