তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে মুখে কুলুপ পুলিশের

Slider বাংলার আদালত

র‌্যাবের হেফাজতে মারা যাওয়া নওগাঁর ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল রবিবার বিকাল ৩টার দিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন এই প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। তবে এই প্রতিবেদন নিয়ে মুখ খুলছেন না কেউ-ই।

ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন রবিবার সন্ধ্যায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘ময়নাতদন্তের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর আমরা তিনজনই বসেছিলাম। বোর্ড বসিয়ে আমরা রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করে মতামত দিয়েছি। এর পর সেটি বিকালেই পুলিশের কাছে হস্তান্তর

করা হয়েছে’। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে জেসমিনের মৃত্যুর কারণ কী এসেছে- তা বলতে রাজি হননি তিনি। প্রতিবেদনের বিস্তারিত জানতে তিনি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘ফরেনসিক বিভাগ থেকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছেই রিপোর্ট হস্তান্তর করার কথা। বিষয়টি আমার জানা নেই’। তিনি তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও রাজপাড়া থানার এসআই সুভাসচন্দ্র বর্মণের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান। তিনি আরএমপির মিডিয়া উইংয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে কিছু জানেন বলে দাবি করেছেন আরএমপির মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার রফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘এটি জুডিয়শিয়াল ডকুমেন্ট। মেডিক্যাল কলেজে থেকে পুলিশের হাতে এসে থাকলেও আমি জানি না। এ বিষয়ে কিছু বলতেও পারব না’।

জানা গেছে, সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেট। মারা যাওয়ার পর সুলতানা জেসমিনের শরীরের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ বা অস্বাভাবিক অবস্থা থাকলে তা সুরতহাল প্রতিবেদনে থাকার কথা। কিন্তু সুরতহাল প্রতিবেদনে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা যা পেয়েছেন মরদেহে তার চেয়েও বেশি কিছু অস্বাভাবিক দেখতে পেয়েছেন। জেসমিনের শারীরিক অবস্থার অনেক কিছুই সুরতহাল প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। জেসমিনের মরদেহে ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি এই তথ্য জানিয়েছেন।

ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই ব্যক্তি আরও জানান, সুলতানা জেসমিনের মরদেহের ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের মর্গে প্রথমে গিয়েছিলেন ফরেনসিক বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. তাজনীন জাহান। তারই ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সুরতহাল প্রতিবেদন যা উল্লেখ ছিল মরদেহে তার চেয়েও অস্বাভাবিক অবস্থা দেখতে পান। এর পর তিনিই বিভাগীয় প্রধানকে মর্গে ডাকেন। তার ডাকে বিভাগীয় প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন আরেক প্রভাষক জামান নিশাত রায়হানকে সঙ্গে নিয়ে মর্গে যান। পরে জেসমিনের মরদেহ তারা একসঙ্গে দেখেন। এর পর তিনজনের সমন্বয়ে বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত করেন।

মৃত জেসমিনের মামা নাজমুল হক মন্টু রবিবার বিকালে বলেন, ‘আজ জেসমিনের কুলখানি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমরা শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। জেসমিনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর হাইকোর্ট কী নির্দেশনা দিচ্ছেন তার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। হাইকোর্টের মন্তব্য জানার পর আমরা মামলার সিদ্ধান্ত নেব’। যদিও নাজমুল হকের অভিযোগ, র‌্যাব হেফাজতে নির্যাতনের কারণেই জেসমিনের মৃত্যু হয়েছে।

র‌্যাব ৫-এর জয়পুরহাট ক্যাম্পের একটি দল গত ২২ মার্চ সকালে জেসমিনকে আটক করে। স্থানীয় সরকারের রাজশাহী বিভাগের পরিচালক মো. এনামুল হকের মৌখিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে নিয়েই র‌্যাব এ অভিযান চালায়। এনামুল হকের অভিযোগ, জেসমিন ও আল-আমিন নামের এক ব্যক্তি তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছিলেন বিভিন্নজনকে। এভাবে তারা প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন।

এদিকে আটকের পর ২৪ মার্চ সকালে রাজশাহীতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জেসমিন মারা যান। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। জেসমিনের মৃত্যুর পর দিন ২৫ মার্চ রামেকের মর্গে মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। এর পর কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জেসমিনের মরদেহ গোসল করানো হয় রাজশাহীতেই। পরে কাফন পরানো মরদেহ কফিনে করে নওগাঁয় নিয়ে যায় র‌্যাব। সেখানে র‌্যাবের উপস্থিতিতেই মরদেহ দাফন করেন স্বজনরা।

জেসমিনের মৃত্যুর পর রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যুগ্ম সচিব এনামুল হকের করা একটি মামলার কথা জানা যায়, যেটি রেকর্ডের সময় ২৩ মার্চ বিকাল। জেসমিন ও তার কথিত সহযোগী আল-আমিনকে এতে আসামি করা হয়। আল-আমিনকে ২৬ মার্চ ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তিনি একজন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট।

জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় র‌্যাব ৫-এর জয়পুরহাট ক্যাম্পের ১১ জন সদস্যকে রাজশাহীতে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে আনা হয়। র‌্যাবের গঠিত একটি তদন্ত কমিটির সদস্যরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। র‌্যাব ৫-এর রাজশাহীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার জানান, তদন্ত কমিটির কাজ এখনো শেষ হয়নি। রবিবারও তারা কাজ করেছেন। তদন্ত শেষে কমিটি ঢাকায় ফিরে র‌্যাব সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দেবে।

জেসমিনকে আটক এবং তার মৃত্যুর ব্যাপারে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘এ ব্যাপারে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে একটি প্রতিবেদন এসেছে। প্রতিবেদনটি এখনো পর্যালোচনা করে দেখা হয়নি। এটি না হওয়ার কারণে এখন গণমাধ্যমে বলার মতো কোনো কথা নেই’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *