বাংলা সিনেমার বাবারা

Slider বিনোদন ও মিডিয়া

file (3)
ছেলেটি যখন ছোট তখন খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে যান নিরাপরাধ বাবা। ছেলেটি বড় হয়ে আইনজীবী হয়। বাবাকে মুক্ত করার জন্য নতুনভাবে শুরু করে আইনি লড়াই। অবশেষে আদালতে সে প্রমাণ করে দেয় তার বাবা নির্দোষ। বাবাকে মুক্ত করার জন্য ছেলের এই সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্র ‘সবার উপরে’। এই চলচ্চিত্রে বাবার ভুমিকায় ছবি বিশ্বাস এবং ছেলের ভূমিকায় উত্তম কুমার অভিনয় করেন।

এপার বাংলা ও ওপার বাংলার চলচ্চিত্রে বাবাকে নানাভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। রূপালি পর্দায় যে বাবাদের দেখা যায় তারা কখনও কঠোর, কখনও স্নেহময়, কখনও আদর্শবাদী আবার কখনও তারা বিপথগামী। তবে বাবা অথবা সন্তান যেই বিপথগামী হোক না কেন সিনেমার শেষ পর্যায়ে তারা ফিরে আসে একে অন্যের কাছে। হয়তো যে কোনো একজন বা দুজনের মৃত্যুতে পরিসমাপ্তি ঘটে তাদের দ্বন্দ্বের। আবার কখনও ঘটে মধুরেন সমাপয়েৎ।

বাংলা চলচ্চিত্রে বাবা-ছেলের ভূমিকায় দ্বৈত অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার, রাজ্জাকসহ অনেক অভিনেতা। আবার বাস্তবজীবনে বাবা ও সন্তান চলচ্চিত্রে এসেছেন এমনও বিরল নয়।

বাংলাদেশের সিনেমায় নায়করাজ রাজ্জাকের দুই ছেলে বাপ্পা রাজ ও সম্রাট সিনেমায় এসেছেন। সোহেল রানার ছেলে ইয়ুলও অভিনয় করছেন সিনেমায়। বাবা গোলাম মুস্তাফার পদাঙ্ক অনুসরণ করে অভিনয়ে এসেছেন সুবর্ণা মুস্তাফা। আবুল হায়াত এবং বিপাশা হায়াত দুজনেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বাবা আলী যাকেরের পথে অভিনয়ে এসেছেন ইরেশ যাকের। শহীদ বুদ্ধিজীবী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের সন্তান অনল রায়হান, বিপুল রায়হান এবং তপু রায়হান চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত। বিপুল ও অনল নাট্য নির্মাতা এবং তপু অভিনেতা। প্রখ্যাত অভিনেতা ও নির্মাতা আমজাদ হোসেনের ছেলে সোহেল আরমান অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। ওমর সানী-মৌসুমীর ছেলে ফারদীন আত্মপ্রকাশ করেছেন চিত্রপরিচালক হিসেবে। ইনামুল হক ও লাকি ইনামের সন্তান হৃদি হক অভিনয় জগতে এসেছেন। রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী মজুমদারের কন্যা ত্রপা মজুমদার অভিনেত্রী হিসেবে খ্যাত।

পশ্চিমবঙ্গে ও বলিউডে ষাটের দশকের প্রখ্যাত নায়ক বিশ্বজিতের ছেলে প্রসেনজিৎ খ্যাতিতে বাবাকে ছাড়িয়ে গেছেন। বিশ্বজিতের দ্বিতীয় বিয়েকে কেন্দ্র করে বাবা-ছেলের সম্পর্ক ছিল বেশ তিক্ত। তবে দীর্ঘ বিশ বছর পর তাদের মধ্যে বরফ গলে।

বাংলাদেশে নির্মিত অনেক সিনেমাতেই চিত্রনাট্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাবার চরিত্র। এক সময় পর্দায় দাপুটে বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফতেহ লোহানী, খলিল, গোলাম মুস্তাফা, দারাশিকো, আবদুল মতিন। আদর্শবাদী বাবার ভূমিকায় মানানসই ছিলেন আনোয়ার হোসেন ও প্রবীর মিত্র। পরবর্তীতে রাজীব, আহমদ শরীফ খলনায়ক থেকে রাগী বাবার ভূমিকায় দর্শকপ্রিয়তা পান। পশ্চিমবঙ্গে দাপুটে ও রাশভারী বাবার ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, উৎপল দত্ত ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। স্নেহময় বাবার ভূমিকায় মানানসই ছিলেন পাহাড়ী স্যান্যাল, কালী ব্যানার্জি। পরবর্তিতে দীপংকর দে, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, অনীল চট্টোপাধ্যায়, বাবার ভূমিকায় সার্থক অভিনয় করেছেন।

বাবাকেন্দ্রিক সিনেমার প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে পড়ছে ‘বাবা কেন চাকর’ সিনেমাটির নাম। এখানে আদর্শবাদী এবং বৃদ্ধ বয়সে সন্তান দ্বারা নিপীড়িত বাবার চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক। ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি ব্যবসাসফল হয়। ছবিটির পরিচালক ছিলেন রাজ্জাক এবং প্রযোজনায় ছিল রাজলক্ষী প্রোডাকশন।

‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ সিনেমায় স্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন বুলবুল আহমেদ একক বাবা হিসেবে শিশু সন্তানকে বড় করে তোলেন। সিনেমাটিতে বাবা-সন্তানের বেশ কিছু আবেগঘন দৃশ্য রয়েছে। এ ছবির ‘বাবা বলে গেল’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায় আশির দশকে।

আশির দশকে ‘আগুন’ ছবিতে বাবা-ছেলের দ্বৈত ভূমিকায় ছিলেন রাজ্জাক। বাবা ও ছেলের কণ্ঠে ‘মুন্না আমার লক্ষ্মীসোনা’ গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায় সেসময়।

‘নয়নের আলো’ ছবিতে ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’ আশির দশকে লোকের মুখে মুখে ফিরত।গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর আর পর্দায় ছিলেন প্রয়াত জাফর ইকবাল।

মাসুদ আখন্দ পরিচালিত ‘পিতা’ সিনেমাটি গ্রামীণ পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত মান্না অভিনীত ‘কাবুলীওয়ালা’ সিনেমাটিও বাবাকেন্দ্রিক। এখানে শ্বাশত পিতৃত্বের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বাবা ও মেয়ের চিরন্তন স্নেহ ও নির্ভরতার সম্পর্কের চিত্রায়ন দর্শককে আবেগতাড়িত করে। এই ছবিটি অবশ্য ষাটের দশকে পশ্চিম বাংলাতেও নির্মিত হয়েছে। সেখানে কাবুলীওয়ালার ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন ছবি বিশ্বাস। মিনির ভূমিকায় ছিলেন টিংকু ঠাকুর।

দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত ‘বাপ বেটির যুদ্ধ’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, আলমগীর, শাকিব খান ও পপি। সিনেমাটিতে বাবা-মেয়ের দ্বন্দ্ব কাহিনির গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

‘দীপু নাম্বার টু’ সিনেমায় একক বাবা বুলবুল আহমেদের সঙ্গে তার সন্তানের সম্পর্ককে তুলে ধরা হয়েছে। জাফর ইকবালের জনপ্রিয় কিশোর ক্ল্যাসিক অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।

উত্তম কুমার-অশোক কুমার এবং রাকেশ রোশন অভিনীত আনন্দ আশ্রম বাবা ও সন্তানের সম্পর্ককেন্দ্রিক এক জনপ্রিয় সিনেমা। ‘আনন্দ আশ্রমে’র কাহিনি অবশ্য গতানুগতিক। সিনেমায় দেখা যায়, বাবার (অশোক কুমারের) অমতে প্রেমিকা আশাকে (শর্মিলা ঠাকুর) বিয়ে করায় বাড়ি থেকে চলে যেতে হয় ডা. দীপক(উত্তম কুমার)কে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে স্ত্রীর মৃত্যু হলে নবজাত শিশুকে বাবার কাছে পাঠিয়ে দেন দীপক। ছেলে প্রতাপ (রাকেশ রোশন) বড় হলে তার বিয়ে উপলক্ষে বহু বছর পর নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন দীপক। আবেগঘন দৃশ্যের মাধ্যমে মিলন হয় দুই প্রজন্মের বাবা ও ছেলের।

রোমান্টিক নায়ক হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে থাকার সময় দরিদ্র ও অসহায় বাবার ভূমিকায় মর্মস্পর্শী অভিনয় করে দর্শককে আলোড়িত করেন উত্তম কুমার ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ সিনেমায়। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছোটগল্পে দরিদ্র রাইচরণের ভূমিকায় উত্তম কুমারের অভিনয় আজও বাংলা চলচ্চিত্রের স্মরণীয় অধ্যায়।

বাংলাদেশে নির্মিত বাবাকেন্দ্রিক সিনেমার মধ্যে ক্ল্যাসিক হল ‘দ্য ফাদার’। কাজী হায়াৎ পরিচালিত ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটির কাহিনিও অত্যন্ত ব্যতিক্রমী। বিদেশী নাগরিক শ্বেতাঙ্গ জন বাংলাদেশের একটি শিশুকে লালন পালন করেন পিতৃস্নেহে। শিশুর নাম দেন তিনি ‘খুকু’। খুকু বড় হয়ে উঠলে বাবা-কন্যার সম্পর্কের টানাপড়েন, খুকুর শ্বশুর বাড়িতে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। এ ছবিতে জনের একটি বিখ্যাত সংলাপ ‘এত বছর বাংলাদেশে থাকিয়াও আমি বাঙালি হইতে পারি নাই, খুকুর বাবা হইতে পারি নাই’। খুকুর ভূমিকায় সুচরিতা এবং জনের ভূমিকায় জন নেপিয়ার এডামস অভিনয় করেন। ব্যক্তিগত জীবনে এডামস বাংলাদেশে ইউএস এইড প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। সুপার হিট এ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘আয় খুকু আয়’ গানটি দারুণ লাগসইভাবে ব্যবহার করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *