রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নকশার কমলাপুরের একটি অংশ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। কমলাপুর মাল্টিমোডাল হাবের সঙ্গে উড়ালসড়কের নকশা সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। মেট্রোরেলের এমআরটি-৫ লাইনের অ্যালাইনমেন্ট নিয়ে তৈরি হয়েছে বিরোধ। আবার প্রকল্পের শুরুতে বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল এলাকার সামনে র্যাম্প স্থাপনের বিষয়ে সমাধান হয়নি আজও। মহাখালীতে ওজনস্টেশন নির্মাণ করা যাচ্ছে না। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সঙ্গে জমি নিয়ে জটিলতা তো আছেই। এর পর হাতিরঝিলে পিলার নির্মাণে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কথা জানিয়েছে রাজউক। খানিকটা এগিয়ে পান্থকুঞ্জে করার প্রস্তাবে আপত্তি আছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের।
এ ধরনের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে বৈঠক হয়েছে। সেখান থেকে কিছু নির্দেশনা আসে। ওই বৈঠকে সেতু বিভাগ, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, রেলওয়ে, রাজউক, দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় ‘মাল্টিমোডাল হাব’ নির্মাণ করবে রেলওয়ে। এ কারণে উড়ালসড়কের অ্যালাইনমেন্ট এবং মাল্টিমোডাল হাবের নকশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়। এ নিয়ে উভয় সংস্থার প্রতিনিধিরা বৈঠক করেও সমাধান বের করতে পারেননি। অ্যালাইনমেন্ট কিছুটা পরিবর্তন ও টোলপ্লাজার অবস্থান সরিয়ে দক্ষিণ দিকে করার প্রস্তাব করে রেলওয়ে। উড়ালসড়কের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সে অনুযায়ী নকশা তৈরি করতে রাজিও হয়। তবে ট্রাফিক ডিমান্ড বিবেচনা করে ৮ লেনের টোলপ্লাজা (৪+৪) দুই ভাগে বিভক্ত করে ‘স্টেগার্ড ওয়েতে’ নির্মাণের প্রস্তাব পাঠায় সেতু কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ে চায় টোলপ্লাজাটা উত্তর দিক থেকে সরিয়ে দক্ষিণে নিতে। রেল ও সেতু কর্তৃপক্ষকে বৈঠক করে বিষয়টি সমাধানের নির্দেশ দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
এদিকে হাতিরঝিলে উড়ালসড়কের একটি লিঙ্ক মগবাজার রেলগেট থেকে শুরু হয়ে বিয়ামের পাশ দিয়ে পান্থকুঞ্জ পার্কের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে হাতিরপুল-কাঁটাবন-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পলাশীর মোড় পর্যন্ত যাবে। এটি বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক এবং হাতিরঝিল প্রকল্পের স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘ভিত্তি স্থপতি বৃন্দ লিমিটেডের’ সঙ্গে বৈঠক করে চূড়ান্ত করা অ্যালাইনমেন্ট।
হাতিরঝিলে অবস্থিত ৬ ফুট ব্যাসের দুটি স্যুয়ারেজ লাইন অক্ষত রেখে এবং হাতিরঝিলের জলাধারের মধ্যে যথাসম্ভব পিয়ারের অবস্থান পরিহার করা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিনের। কিন্তু কাজটি শুরু করতে হলে রাজউকের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত করতে হবে।
রাজউক জানিয়েছে, হাতিরঝিল এলাকায় কোনো প্রকার স্থাপনা নির্মাণ না করার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তোলা হলেও সমাধান হয়নি। তাই অবস্থা বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারসংক্ষেপ পাঠানোর কথা বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়, উড়ালসড়ক প্রকল্পটি বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে শুরু হয়ে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও এবং কমলাপুর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে। প্রকল্পের একটি অংশ যাবে বিয়ামের পাশে পান্থকুঞ্জ দিয়ে পলাশী মোড় পর্যন্ত। কিন্তু এ লিঙ্কের ইউটিলিটি লাইন সরানো যাচ্ছে না। কারণ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ পাঠালেও পরে ফেরত পাঠানো হয়। এর সমাধান এখনো হয়নি। আর সমাধান না হওয়ায় ডিটিসিএর বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত হয়, বিষয়টি স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি সমাধানে ব্যবস্থা নেবে।
মহাখালীতে ওয়ে ব্রিজ এবং কুড়িল ও বিমানবন্দর সড়কে সাইনবোর্ড স্থাপন নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। উড়ালসড়কের কাজে সওজের ২৬ একর জমি ব্যবহারের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এমওইউ সই হয়েছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের মধ্যে একটি ‘আপ র্যাম্প’ মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম দিক থেকে উঠে মেট্রোপলিটন হাসপাতালসংলগ্ন টোলপ্লাজা হয়ে মূল এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে।
উড়ালসড়কের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী, ওজনস্টেশনটি মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিমে সওজের জায়গায় বসানোর জন্য নির্ধারিত আছে। তবে সওজ ও প্রকল্প কর্মকতাদের যৌথ পরিদর্শনে দেখা যায়, ওই ওজনস্টেশনের জন্য দশমিক ২২ একর জায়গা দরকার। এ নিয়ে গত ১৫ জানুয়ারি সেতু বিভাগ ও সড়ক বিভাগের সঙ্গে বৈঠক হয়। দ্রুত ওজনস্টেশন ও সাইনবোর্ড স্থাপনসহ সমস্যা সমাধানের কথা বলেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
এ ছাড়া মেট্রোরেল ৫-এর সঙ্গে উড়ালসড়কের অ্যালাইনমেন্টের বিপত্তি আছে। অ্যালাইনমেন্ট সংক্রান্ত বিরোধ নিরসনে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে সময়, নকশা ও নির্মাণ খরচ বিবেচনা করে ব্যয় প্রাক্কলনের কথা বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত দ্বিতীয় প্রস্তাব বাস্তবায়নে বিদ্যমান সড়কের বিভিন্ন লোকেশনে গভীর খননের দরকার পড়বে। এমনকি ওই সড়ক কমপক্ষে তিন মাস ট্রাফিক চলাচলের জন্য বন্ধ রাখতে হবে। এ বিবেচনায় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, পুনঃনকশা এবং নির্মাণকাজে অতিরিক্ত ৬০ লাখ ডলার ও অতিরিক্ত ২৩৮ দিন প্রয়োজন হবে। এর সমাধানে সেতু বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সমন্বয়ে সভা করার কথা বলা হয়েছে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের কাছে এক্সিট র্যাম্পের জন্য ভূমি হস্তান্তর নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। থার্ড টার্মিনালে এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটির প্রথম ধাপের এক্সিট র্যাম্প নির্মাণের জন্য ১০০ মিটার জমি হস্তান্তর করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বাকি ১৪০ মিটার জমি হস্তান্তর না করার কারণে এক্সিট র্যাম্প নির্মাণ করা যাচ্ছে না। জমি হস্তান্তরের পর এক্সিট র্যাম্পটি নির্মাণে দেরি হলে এক্সপ্রেসওয়েটি চালু করতেও বিলম্ব হবে। এ বিষয়ে বেবিচক ও প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আকতার বলেন, ‘সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
সূত্র জানায়, দফায় দফায় পরিবর্তন করতে হয়েছে ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পের। এক যুগ আগে নেওয়া প্রকল্পটি কবে শেষ হবে, তার ইয়ত্তা নেই। বার বার বদল করা হয় অ্যালাইনমেন্ট।
এ প্রকল্পে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড। শেয়ারহোল্ডার হিসেবে আছে থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড’ (৫১ শতাংশ)।
প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর। তার আগে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।