শিক্ষার্থী নির্যাতনের একাধিক ঘটনায় ফের অভিযোগ ছাত্রলীগের দিকে

Slider রাজনীতি

বাংলাদেশে সম্প্রতি কমপক্ষে তিনটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা সামনে এসেছে এবং প্রায় প্রতিটিতেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী নির্যাতনের এরকম ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ২০১৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড।

ওই হত্যার ঘটনায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল এবং আরো কয়েকজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। রায়ে বলা হয়েছিলো, শাস্তিপ্রাপ্তরা পরস্পর যোগসাজশে ‘শিবির সন্দেহে’ আবরার ফাহাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছিল।

এ ঘটনায় ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার কর্মীরা জড়িত ছিল।

আরেকটি ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ২০২১ সালের অক্টোবরে। তখন এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহাদি জে আকিবকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। তার মাথায় সাদা ব্যান্ডেজে লেখা “হাড় নেই, চাপ দেবেন না” ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

এই ঘটনায়ও অভিযোগের আঙুল ছিল ছাত্রলীগের দিকে।

এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই প্রতিষ্ঠানের চার শিক্ষার্থীকে ছাত্রাবাসে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

চমেকের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার বলেন, খবর পেয়ে পুলিশের সহায়তায় হোস্টেলে গিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে সেসময় তাৎক্ষণিকভাবে তারা কোন অভিযোগ করেনি।

পরে গত পরশু তারা অভিভাবকদের সহায়তায় একটি আবেদন করে জানিয়েছে যে তাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছে। এই আবেদনের পর আগের তদন্ত বাদ দিয়ে নতুন করে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করা হচ্ছে।

সাহেনা আক্তার জানান, তদন্ত করে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে।

এর আগে ২০২১ সালে আকিবকে নির্যাতনের ঘটনায় তদন্তের পর ৩১ জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছিল উল্লেখ করে সাহেনা আক্তার জানান, এবারো দোষীদের ছাড় দেয়া হবে না।

এবারের শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায়ও অভিযোগ আনা হয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

তবে বার বার কেন চমেকে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে- এমন প্রশ্নে সাহেনা আক্তার বলেন, ওইটা ছিল ২০২১ সালের ঘটনা, এখন ২০২৩ সাল। তাহলে দেড় বছর তো কলেজ শান্ত ছিল।

“বারবার বলতে মনে হচ্ছে প্রতি মাসে হচ্ছে তা কিন্তু না। অক্টোবর ২১ এর পর ২৩ এর ফেব্রুয়ারি চলে এসেছে।”

সাহেনা আক্তার বলেন, তারা এটার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। কলেজ প্রশাসন কখনোই এগুলোকে প্রশ্রয় দেবে না।

“দেড় বছরে আর কোনো ঘটনা শুনছেন? শুনেন নাই তো। দেড় বছর পর একটা ঘটনা হইছে, আমরা তো ব্যবস্থা নিচ্ছি।”

তিনি বলেন, কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে তথ্য-প্রমাণ মজবুত হওয়াটা জরুরি। আর তদন্তও একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় বলে সময় দরকার হয়।

তবে ঘটনা এখানেই থেমে নেই। গত প্রায় সপ্তাহ খানেক সময়ের মধ্যে অন্তত আরো দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ সামনে এসেছে।

এর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতনের শিকার ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও হল প্রাধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এই অভিযোগে তিনি বলেছেন যে, তাকে নির্যাতন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ছাত্রলীগের সদস্যরা।

তিনি তার তার অভিযোগ বলেছেন যে, তাকে ‘শিবিরের’ সদস্য হিসেবে উল্লেখ করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়েছে।

এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়টির ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এছাড়া কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রলীগের নারী কর্মীরা প্রায় চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই শিক্ষার্থী এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে, ওই শিক্ষার্থী বর্তমানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা সেসময় বন্ধ পাওয়া যায়।

ছাত্রলীগ কী বলছে?
বাংলাদেশে শিক্ষার্থী নির্যাতনের সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় বরাবরই অভিযোগের আঙুল থাকে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দিকে।

তবে এই সংগঠনটি বলছে যে, নির্যাতনের মতো কোনো ঘটনার পক্ষে তাদের অবস্থান নেই।

এ বিষয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, র‍্যাগিংয়ের বিষয়ে জিরো টলারেন্সের নীতি রয়েছে তাদের।

অনেক ক্যাম্পাসে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কাউকে যখন শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয় সেটি ফৌজদারি অপরাধ। এ ধরনের কাজে কেউ জড়িত থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া আছে।

সাদ্দাম হোসেন বলেন, ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কেউ এ ধরনের কাজ করলে তাকে তাৎক্ষণিক বহিষ্কার করা হচ্ছে।

এদিকে, শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের সাথে অনেক সময়ই শিবির তকমা কেন দেয়া হয় এ বিষয়ে সাদ্দাম হোসেন বলেন, ছাত্র শিবিরের বিষয়টি হচ্ছে তারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠন।

তিনি বলেন, এদের প্রতিহত করা প্রত্যেকটি ছাত্র সংগঠনের দায়িত্ব এবং এটি তারা করে আসছে।

“যুদ্ধাপরাধীদের যারা পৃষ্ঠপোষক, যারা খুনীদের পুনর্বাসন করবে, তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়া দায়িত্ব, এটা দেশপ্রেমের অংশ।”

কী ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে?
বাংলাদেশে শিক্ষার্থী নির্যাতনের এ ধরনের অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া গেলেও তা একেবারে বন্ধ করা যায় না।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন-ইউজিসি থেকে জানা যায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে আসলে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো সংস্থা বা কোনো কমিটি নেই।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা নিয়ম-কানুন রয়েছে বলে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন।

ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর জানান, ইউজিসির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্পষ্টভাবে চিঠি দিয়ে নির্যাতন রুখতে বলা হয়েছে।

তিনি জানান, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা আছে এবং সেখানেই উল্লেখ করা আছে যে এ ধরনের বিষয়ে কী ধরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। এই নীতিমালা অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করার মতো পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি অপরাধীদের আইনের হাতে তুলে দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু নিজস্ব আইনে চলে তাই এসব শাস্তিমূলক ব্যবস্ধা দ্রুততম সময়ে নেয়া দরকার।

“বিশ্ববিদ্যালয়ই যথেষ্ট এই ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে,” বলেন আলমগীর।

হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূলক। ইউজিসিতেও এমন একটি সেল থাকলেও সেটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে কাজ করে না।

আলমগীর বলেন, সমাজে অনেক সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে অনেকে পার পেয়ে যায় বলে এ ধরণের ঘটনা ঘটাতে অন্যরা আগ্রহী হয়।

আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও তার বিরুদ্ধে দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলেও এ ধরণের অপরাধ থামে না বলে মনে করেন তিনি।

আলমগীর বলেন, শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনা না থামলেও এগুলো কমে গেছে। তবে একেবারে বন্ধ করতে সময় লাগবে বলেও মনে করেন তিনি।

তবে আইন করে বা শাস্তি দিয়ে এগুলো বন্ধ করা যাবে না বলেও তার মত। তিনি বলেন, এসব ঘটনা থামাতে সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *