হাসান আলীর যুদ্ধাপরাধের রায়ের অপেক্ষা

Slider জাতীয়

Hasan_Ali_761080653
ঢাকা: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর মামলার রায় ঘোষণা করা হবে মঙ্গলবার (৯ জুন)। সকালে এ রায় দেবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলাগুলোর মধ্যে ১৯তম এ রায় দেবেন। ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।

গত ২০ এপ্রিল উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।

গত ১৫ ও ১৯ এপ্রিল হাসান আলীর বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী। অন্যদিকে ২০ এপ্রিল হাসান আলীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান।

গত বছরের ৮ ডিসেম্বর থেকে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত হাসান আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা হরি দেবনাথসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ২৬ জন সাক্ষী। অন্য সাক্ষীরা হচ্ছেন, শহীদপুত্র রেনু চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র সমেন্দ্র চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র সুনীল চন্দ্র পাল, শহীদপুত্র খগেশ চন্দ্র পাল, নূরুল হক লাল মিয়া, রাহিমা ওরফে আবুনি, মোঃ এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া, মোঃ শাহজাহান ভূঁইয়া, রেখা রানী ঘোষ, সঞ্জিব কুমার সরকার, বাঁধন চক্রবর্তী, মো. আতাহার আলী ভূঁইয়া, মোঃ আব্দুল্লাহ, শহীদপুত্র মোঃ কাইয়ুম, আলহাজ মোঃ শামসুল আলম, শহীদজায়া সঞ্জু বালা ঘোষ, শহীদ পরিবারের সদস্য ননী গোপাল ঘোষ, শহীদ পরিবারের সদস্য মিনা রানী সরকার, শহীদপুত্র নারায়ণ চন্দ্র চক্রবর্তী, শহীদ পরিবারের সদস্য গৌরী রাণী চক্রবর্তী, মোঃ হাদিস, সুরাইয়া ওরফে ফসিলা, মাহফুজা আক্তার।

অন্যদিকে আসামির পক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী ছিলেন না।

গত বছরের ৭ ডিসেম্বর হাসান আলীর বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী।

গত বছরের ১১ নভেম্বর হাসান আলীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুট, আটক ও নির্যাতনের ৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে ২৪ জনকে হত্যা, ১২ জনকে অপহরণ ও আটক এবং ১২৫টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ রয়েছে।

গত বছরের ২২ অক্টোবর ও ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ও প্রসিকিউটর আবুল কালাম আজাদ। অন্যদিকে ২২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন হাসান আলীর পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান।

গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সৈয়দ মোঃ হাসান আলীর অনুপস্থিতিতে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় আব্দুস শুকুর খানকে রাষ্ট্রীয় খরচে আসামিপক্ষের আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়।

গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আগে থেকেই পালিয়ে থাকা হাসান আলীর বিরুদ্ধে গত বছরের ২৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনই পলাতক এই রাজাকার কমান্ডারকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। পরে তাকে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন প্রসিকিউশন।

গত বছরের ২১ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর আবুল কালাম আজাদ।

গত বছরের ২৯ জুন সৈয়দ মোঃ হাসান আলীর বিরুদ্ধে ৪৭ পৃষ্ঠার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে হস্তান্তর করেন তদন্ত সংস্থা।

হাসান আলীর বিরুদ্ধে গত বছরের ৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর গত ১৪ মাসেও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।

২০১৩ সালের ৬ জুন থেকে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন তদন্ত সংস্থা। গত বছরের ১৯ জুন পর্যন্ত তদন্ত কার্যক্রম শেষে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা হরি দেবনাথ।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন হাসান আলী। সে সময় তিনি তাড়াইল থানা এলাকায় ‘রাজাকারের দারোগা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে না থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতা গ্রামে বসবাস করতেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রাস ছিলেন রাজাকার হাসান আলী। হাসান আলী অন্যান্য সহযোগীসহ তাড়াইল থানার বিভিন্ন এলাকাসহ কিশোরগঞ্জে নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা, বাড়িঘর লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জোর করে টাকা আদায় ও ধর্মান্তরিতকরণসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। তার নির্দেশেই তাড়াইলে হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে।

রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকেও মানবতাবিরোধী অপরাধ কর্মকাণ্ডে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তিনি।

সৈয়দ হাসান আলীর পিতা সৈয়দ মোসলেম উদ্দিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।

তাদের মূল বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সৈয়দ মোসলেম উদ্দিন শিক্ষকতার উদ্দেশ্যে ১৯৩৬ সালে কিশোরগঞ্জ এসে হযরতনগর এলাকায় আনোয়ারুল উলুম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৯ সালে তা কামিল মাদ্রাসায় উন্নীত হয়। তখন তিনি ওই মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৫২ সালে নেজামে ইসলামী পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নিয়োজিত হন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোসলেম উদ্দিন পূর্ব পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান হন। ওই সময় তিনি কিশোরগঞ্জ মহকুমার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতায় ঘোর বিরোধিতাকারী ছিলেন।

পিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করে কিশোরগঞ্জ মহকুমার তাড়াইল থানায় রাজাকার কমান্ডার হিসেবে নিয়োজিত হন সৈয়দ হাসান আলী। তার অন্য এক ভাইও রাজাকার ছিলেন।

হাসান আলীর বিরুদ্ধে ছয় অভিযোগ
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ এপ্রিল সহযোগী রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার সাচাইল গ্রামের হাসান আহমদ ওরফে হাসু বেপারীর ৭টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন তিনি। পরে হাচান আহম্মেদ হেচুকে গুলি করে হত্যা করেন।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৩ আগস্ট তাড়াইল থানার বাড়তি ইউনিয়নের কোনা ভাওয়াল গ্রামের শহীদ তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া ওরফে লালু ভূঁইয়াকে হত্যা করে দু’টি ঘরে লুণ্ঠন এবং দুইজনকে অপহরণ ও আটক করেন হাসান আলী।

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৯ সেপ্টেম্বর তাড়াইল থানার শিমুলহাটি গ্রামের পালপাড়ার অক্রুর পালসহ ১২ জনকে হত্যা এবং ১০টি ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে। ঘর থেকে পুরুষরা বের হওয়ার পর তাদের ধরে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেন হাসান ও সহযোগীরা। যাদের হত্যা করা হয় তারা হলেন- অক্রুর চন্দ্র পাল, শরৎ চন্দ্র পাল, সুরেশ চন্দ্র পাল, উপেন্দ্র চন্দ্র পাল, গোবিন্দ চন্দ্র পাল, ধরনী চন্দ্র পাল, যোগেশ চন্দ্র পাল, দীনেশ চন্দ্র পাল, যতীন্দ্র চন্দ্র পাল, রাখাল চন্দ্র পাল ও মোঃ সুরুজ আলী।

চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ সেপ্টেম্বর সোমবার তাড়াইল থানার ভোরগাঁও গ্রামের বেলংকা রোডে সতিশ ঘোষসহ ৮ জনকে হত্যা ও ১০ জনকে অপহরণ ও লুটপাটে নেতৃত্ব দেন হাসান আলী। ওই দিন ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমান নেত্রকোনা জেলা) কেন্দুয়া থানার পাকুড়া গ্রামে ৮ জন পুরুষ ও ৪-৫ জন নারী ভারতে যাওয়ার জন্য নৌকাযোগে তাড়াইলে আসেন। নৌকার ৮ যাত্রীকে নিচে নামিয়ে এনে গুলি করে হত্যা করেন হাসান ও তার সহযোগীরা। নৌকার ছইয়ের ওপর থেকে আরও তিনজনকে নামিয়ে আনা হয়। যাদের হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে ছিলেন- মঞ্জু বালা ঘোষ, সুরেশ চন্দ্র ঘোষ, জগদীশ চন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণ চন্দ্র ঘোষ শিবু, সুকুমার ঘোষ, রুহিনী চন্দ্র ঘোষ প্রমুখ।

পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৮ অক্টোবর শুক্রবার তাড়াইল থানার তাল জাঙ্গলা ইউনিয়নের আড়াইউড়া গ্রামের চামেলী কুমার ঘোষের বসতবাড়িতে হামলা করে কামিনী কুমার ঘোষ ও জীবন কৃষ্ণ ঘোষকে হত্যা ও ৬টি ঘরে লুটপাট। ওই দিন রাজাকার হাসান আলীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী হামলা চালায়। রাজাকার বাহিনী জীবন কৃষ্ণ ঘোষের স্ত্রী মিলন রানী চক্রবর্তীকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে তার ঘর থেকে সোনা রুপার অলঙ্কার লুট করে নেয়। এরপর জীবন কৃষ্ণ ঘোষকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর রাজাকার হাসান আলীর নির্দেশে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাজাকার বাহিনী পরে কামিনী কুমার ঘোষকেও ধরে এনে নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে গুলি চালালে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে তিনি মারা যান।

ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর তাড়াইল থানার সাচাইল গ্রামের রাশেদ আলী বেপারীকে হত্যা। একই সঙ্গে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ। ওই দিন রাজাকার বাহিনীর ৪০-৫০ জন সদস্য আব্দুর রশিদের বাড়ি ঘেরাও করে। তারপর তাকে ধরে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে হাসান আলীর নেতৃত্বে ওই গ্রামে লুটপাট চালানো হয়। ওই দিন ৬৪টি হিন্দু পরিবারের ১০০টি ঘরও পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *